1 হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি
4 প্রফেসর হুঁশিয়ার আমাদের উপর ভারি রাগ করেছেন। আমরা সেকালের জীবজন্তু সম্বন্ধে নানাকথা ছাপিয়েছি; কিন্তু কোথাও তাঁর অদ্ভুত শিকার কাহিনীর কোনো উল্লেখ করি নি। সত্যি এ আমাদের ভারি অন্যায়। আমরা সে-সব কাহিনী কিছুই জানতাম না। কিন্তু প্রফেসর হুঁশিয়ার তাঁর শিকারের ডায়েরি থেকে কিছু কিছু উদ্ধার করে আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা তারই কিছু কিছু ছাপিয়ে দিলাম। এ-সব কথা সত্যি কি মিথ্যা তা তোমরা বিচার করে নিয়ো।
6 ২৬শে জুন ১৯২২--- কারাকোরম্, বন্দাকুশ পাহাড়ের দশ মাইল উত্তর। আমরা এখন সবসুদ্ধ দশজন--- আমি, আমার ভাগ্নে চন্দ্রখাই, দুইজন শিকারী (ছক্কড় সিং আর লক্কড় সিং) আর ছয়জন কুলি। আমার কুকুরটাও সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে।
8 নদীর ধারে তাঁবু খাটিয়ে জিনিসপত্র সব কুলিদের জিম্মায় দিয়ে, আমি, চন্দ্রখাই আর শিকারী দুজনকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে বন্দুক, ম্যাপ আর একটা মস্ত বাক্স, তাতে আমাদের যন্ত্রপাতি আর খাবার জিনিস। দুঘণ্টা পথ চলে আমরা এক জায়গায় এলাম, সেখানকার সবই কেমন অদ্ভুতরকম। বড়ো-বড়ো গাছ, তার একটারও নাম আমরা জানি না। একটা গাছে প্রকাণ্ড বেলের মতো মস্ত-মস্ত লাল রঙের ফল ঝুলছে; একটা ফুলের গাছ দেখলাম, তাতে হলদে সাদা ফুল হয়েছে, এক-একটা দেড় হাত লম্বা। আর-একটা গাছে ঝিঙের মতো কি সব ঝুলছে, পঁচিশ হাত দূর থেকে তার ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়। আমরা অবাক হয়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় হঠাত্ হুপ্হাপ্ গুব্গাপ্ শব্দে পাহাড়ের উপর থেকে ভয়ানক একটা কোলাহল শোনা গেল।
10 আমি আর শিকারী দুজন তত্ক্ষণাত্ বন্দুক নিয়ে খাড়া; কিন্তু চন্দ্রখাই বাক্স থেকে দুই টিন জ্যাম বের করে নিশ্চিন্তে বসে খেতে লাগল। ঐটে তার একটা মস্ত দোষ; খাওয়া পেলে আর তার বিপদ আপদ কিছু জ্ঞান থাকে না। এইভাবে প্রায় মিনিট দুই দাঁড়িয়ে থাকবার পর লক্কড় সিং হঠাত্ দেখতে পেল হাতির চাইতেও বড়ো একটা জন্তু গাছের উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। প্রথমে দেখে মনে হল একটা প্রকাণ্ড মানুষ, তার পর মনে হল মানুষ নয় বাঁদর, তার পর দেখি মানুষও নয়, বাঁদরও নয়--- একেবারে নতুন রকমের জন্তু। সে লাল লাল ফলগুলোর খোসা ছাড়িয়ে খাচ্ছে আর আমাদের দিকে ফিরে ফিরে ঠিক মানুষের মতো করে হাসছে। দেখতে দেখতে পঁচিশ-ত্রিশটা ফল সে টপাটপ্ খেয়ে শেষ করল। আমরা এই সুযোগে তার কয়েকখানা ছবি তুলে ফেললাম। তার পর চন্দ্রখাই ভরসা করে এগিয়ে গিয়ে তাকে কিছু খাবার দিয়ে আসল। জন্তুটা মহা খুশি হয়ে এক গ্রাসে আস্ত একখানা পাঁউরুটি আর প্রায় আধসের গুড় শেষ করে, তার পর পাঁচ-সাতটা সিদ্ধ ডিম খোলাসুদ্ধ কড়মড়িয়ে খেয়ে ফেলল। একটা টিনে করে গুড় দেওয়া হয়েছিল, সেই টিনটাও সে খাবার মতলব করেছিল, কিন্তু খানিকক্ষণ চিবিয়ে হঠাত্ বিশ্রী মুখ করে সে কান্নার সুরে গাঁও গাঁও শব্দে বিকট চীত্কার করে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি জন্তুটার নাম দিয়েছি হ্যাংলাথেরিয়াম্।
12 ২৪শে জুলাই, ১৯২২--- বন্দাকুশ পাহাড়ের একুশ মাইল উত্তর। এখানে এত দেখবার জিনিস আছে, নতুন নতুন এত-সব গাছপালা জীবজন্তু, যে তারই সন্ধান করতে আর নমুনা সংগ্রহ করতে আমাদের সময় কেটে যাচ্ছে। দুশোরকম পোকা আর প্রজাপতি আর পাঁচশো রকম গাছপালা ফুলফল সংগ্রহ করেছি; আর ছবি যে কত তুলেছি তার সংখ্যাই হয় না। একটা কোনো জ্যান্ত জানোয়ার ধরে সঙ্গে নেয়ার ইচ্ছা, দেখা যাক কতদূর কি হয়। সেবার যখন কট্ক টোডন্ আমায় তাড়া করেছিল, তখন সে কথা কেউ বিশ্বাস করে নি। এবার তাই জলজ্যান্ত প্রমাণ সংগ্রহ করে নিচ্ছি।
14 আমরা যখন বন্দাকুশ পাহাড়ে উঠেছিলাম, তখন পাহাড়টা কত উঁচু তা মাপা হয়নি। সেদিন জরীপের যন্ত্র দিয়ে আমি আর চন্দ্রখাই পাহাড়টাকে মেপে দেখলাম। আমার হিসেব হল ষোলোহাজার ফুট। কিন্তু চন্দ্রখাই হিসাব করল বেয়াল্লিশহাজার। তাই আজ আবার সাবধানে দুজনে মিলে মেপে দেখলাম, এবার হল মোটে দুহাজার সাতশো ফুট। বোধ হয় আমাদের যন্ত্রে কোনো দোষ হয়ে থাকবে! যাহোক এটা নিশ্চয় যে এপর্যন্ত ঐ পাহাড়ের চুড়োয় আর কেউ ওঠে নি। এ-এক সম্পূর্ণ অজানা দেশ, কোথাও জন মানুষের চিহ্নমাত্র নাই, নিজেদের ম্যাপ নিজেরা তৈরি করে পথ চলতে হয়।
16 আজ সকালে এক কাণ্ড হয়ে গেছে। লক্কড় সিং একটা গাছে হলদে রঙের ফল ফলেছে দেখে তারই একটুখানি খেতে গিয়েছিল। এক কামড় খেতেই হঠাত্ হাত-পা খিঁচিয়ে সে আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে ছট্ফট্ করতে লাগল। তাই দেখে ছক্কড় সিং ``ভাইয়া রে, ভাইয়া'' বলে কেঁদে অস্থির। যাহোক মিনিট দশেক ঐরকম হাত-পা ছুঁড়ে লক্কড় সিং একটু ঠাণ্ডা হয়ে উঠে বসল। তখন আমাদের চোখে পড়ল যে একটা জন্তু কাছেই ঝোপের আড়াল থেকে অত্যন্ত বিরক্ত মতন মুখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারা দেখলে মনে হয় যে, সংসারে তার কোনো সুখ নেই, এ-সব গোলমাল কান্নাকাটি কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। আমি তার নাম দিয়েছি গোমড়াথেরিয়াম্। এমন খিট্খিটে খুঁতখুঁতে গোমড়া মেজাজের জন্তু আর আমরা দ্বিতীয় দেখি নি। আমরা তাকে তোয়াজ টোয়াজ করে খাবার দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করেছিলাম। সে অত্যন্ত বিশ্রী মতো মুখ করে, ফোঁস্ ফোঁস্ ঘোঁত্ ঘোঁত্ করে অনেক আপত্তি জানিয়ে, আধখানা পাঁউরুটি আর দুটো কলা খেয়ে তার পর একটুখানি পেয়ারার জেলি মুখে দিতেই এমন চটে গেল যে রেগে সারা গায়ে জেলি আর মাখন মাখিয়ে আমাদের দিকে পিছন ফিরে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।
18 ১৪ই আগস্ট, বন্দাকুশ পাহাড়ের পঁচিশ মাইল উত্তর--- ট্যাপ্ ট্যাপ্ থ্যাপ্ থ্যাপ্ ঝুপ্ ঝাপ্--- সকালবেলায় খেতে বসেছি, এমন সময় এইরকম একটা শব্দ শোনা গেল। একটুখানি উঁকি মেরে দেখি আমাদের তাঁবুর কাছে প্রায় উটপাখির মতন বড়ো একটা অদ্ভুতরকম পাখি অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কোন দিকে চলবে তার কিছুই যেন ঠিক-ঠিকানা নেই। ডান পা এদিকে যায় তো বাঁ পা ওদিকে; সামনে চলবে তো পিছনভাগে চায়, দশ পা না যেতেই পায়ে পায়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে। তার বোধ হয় ইচ্ছা ছিল তাঁবুটা ভালো করে দেখে, কিন্তু হঠাত্ আমায় দেখতে পেয়ে সে এমন ভড়কে গেল যে তক্ষুনি হুমড়ি খেয়ে হুড়্মুড়্ করে পড়ে গেল। তার পর এক ঠ্যাঙে লাফাতে লাফাতে প্রায় হাত দশেক গিয়ে আবার হেলেদুলে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। চন্দ্রখাই বলল, ``ঠিক হয়েছে, এইটাকে ধরে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাক।'' তখন সকলের উত্সাহ দেখে কে! আমি ছক্কড় সিংকে বললাম, ``তুমি বন্দুকের আওয়াজ কর, তা হলে পাখিটা নিশ্চয়ই চমকে পড়ে যাবে আর সেই সুযোগে আমরা চার-পাঁচজন তাকে চেপে ধরব! ছক্কড় সিং বন্দুক নিয়ে আওয়াজ করতেই পাখিটা ঠ্যাং মুড়ে মাটির উপর বসে পড়ল, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে ক্যাট্ ক্যাট্ শব্দ করে ভয়ানক জোরে ডানা ঝাপ্টাতে লাগল। তাই দেখে আমাদের আর এগুতে সাহস হল না। কিন্তু লক্কড় সিং হাজার হোক তেজী লোক, সে দৌড়ে গিয়ে পাখিটার বুকে ধাঁই করে এক ছাতার বাড়ি বসিয়ে দিল। ছাতার বাড়ি খেয়ে পাখিটা তত্ক্ষণাত্ দুই পা ফাঁক করে উঠে দাঁড়াল। তার পর লক্কড় সিং-এর দাড়িতে কামড়ে ধরে তার ঘাড়ের উপর দুই পা দিয়ে ঝুলে পড়ল। ভাইয়ের বিপদ দেখে ছক্কড় সিং বন্দুকের বাঁট দিয়ে পাখিটার মাথাটা থেঁত্লে দেবার আয়োজন করেছিল। কিন্তু সে আঘাতটা পাখিটার মাথায় লাগল না, লাগল গিয়ে লক্কড় সিং-এর বুকে। তাতে পাখিটা ভয় পেয়ে লক্কড় সিংকে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু দুই ভাইয়ে এমন মারামারি বেঁধে উঠল যে আমরা ভাবলাম দুটোই এবার মরে বুঝি। দুজনের তেজ কি তখন! আমি আর দুজন কুলি লক্কড় সিং-এর জামা ধরে টেনে রাখছি, সে আমাদের সুদ্ধ হিঁচড়ে নিয়ে ভাইয়ের নাকে ঘুষি চালাচ্ছে। চন্দ্রখাই রীতিমতো ভারিক্কে মানুষ; সে ছক্কড় সিং-এর কোমর ধরে লটকে আছে, ছক্কড় সিং তাইসুদ্ধ মাটি থেকে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বন্বন্ করে বন্দুক ঘোরাচ্ছে। হাজার হোক পাঞ্জাবের লোক কি না। মারামারি থামাতে গিয়ে সেই ফাঁকে পাখিটা যে কখন পালালো তা আমরা টেরই পেলাম না। যা হোক এই ল্যাগ্ব্যাগ পাখি বা ল্যাগ-ব্যাগর্নিসের কতকগুলো পালক আর কয়েকটা ফোটোগ্রাফ সংগ্রহ হয়েছিল। তাতেই যথেষ্ট প্রমাণ হবে।
20 ১লা সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে--- আমাদের সঙ্গের খাবার ইত্যাদি ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। তরিতরকারি যা ছিল, তা তো আগেই ফুরিয়েছে। টাটকা জিনিসের মধ্যে সঙ্গে কতগুলো হাঁস আর মুরগী আছে, তারা রোজ কয়েকটা করে ডিম দেয়, তা ছাড়া খালি বিস্কুট, জ্যাম, টিনের দুধ আর ফল, টিনের মাছ, আর মাংস। এই-সব কয়েক সপ্তাহের মতো আছে, সুতরাং এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের ফিরতে হবে। আমরা এই সব জিনিস গুনছি আর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছি, এমন সময় ছক্কড় সিং বলল, যে লক্কড় সিং ভোরবেলা কোথায় বেরিয়েছে, এখন পর্যন্ত ফেরে নি। আমরা বললাম, ``ব্যস্ত কেন, সে আসবে এখন। যাবে আবার কোথায়? কিন্তু তার পরেও দুই-তিন ঘণ্টা গেল অথচ লক্কড় সিং-এর দেখা পাওয়া গেল না। আমরা তাকে খুঁজতে বেরুবার পরামর্শ করছি, এমন সময় হঠাত্ একটা ঝোপের উপর দিয়ে একটা প্রকাণ্ড জানোয়ারের মাথা দেখা গেল। মাথাটা উঠছে নামছে আর মাতালের মতো টলছে। দেখেই আমরা সুড়্সুড়্ করে তাঁবুর আড়ালে পালাতে যাচ্ছি, এমন সময় শুনলাম লক্কড় সিং চেঁচিয়ে বলছে, ``পালিয়ো না, পালিয়ো না, ও কিছু বলবে না।'' তার পরের মুহূর্তেই দেখি লক্কড় সিং বুক ফুলিয়ে সেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার পাগড়ীর কাপড় দিয়ে সে ঐ অত বড়ো জানোয়ারটাকে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে লক্কড় সিং বলল, যে সে সকালবেলায় কুঁজো নিয়ে নদী থেকে জল আনতে গিয়েছিল। ফিরবার সময় এই জন্তুটার সাথে তার দেখা। তাকে দেখেই জন্তুটা মাটিতে শুয়ে কোঁ-কোঁ শব্দ করতে লাগল। সে দেখল জন্তুটার পায়ে কাঁটা ফুটেছে আর তাই দিয়ে দর্দর্ করে রক্ত পড়ছে। লক্কড় সিং খুব সাহস করে তার পায়ের কাঁটাটি তুলে, বেশ করে মুছে, নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে দিল। তার পর জানোয়ারটা তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে দেখে সে তাকে পাগড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমরা সবাই বললাম, ``তা হলে এটা ঐরকম বাঁধাই থাক, দেখি ওটাকে সঙ্গে করে দেশে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।'' জন্তুটার নাম রাখা গেল ল্যাংড়াথেরিয়াম্।
22 সকালে তো এই কাণ্ড হল; বিকালবেলা আর এক ফ্যাসাদ উপস্থিত। তখন আমরা সবেমাত্র তাঁবুতে ফিরেছি। হঠাত্ আমাদের তাঁবুর বেশ কাছেই একটা বিকট চীত্কারের শব্দ শোনা গেল। অনেকগুলো চিল আর পেঁচা একসঙ্গে চেঁচালে যেরকম আওয়াজ হয়, কতকটা সেইরকম। ল্যাংড়াথেরিয়ামটা ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে একটা গাছের লম্বা-লম্বা পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছিল; চীত্কার শুনবামাত্র সে, ঠিক শেয়াল যেমন করে ফেউ ডাকে সেইরকম ধরনের একটা বিকট শব্দ করে, বাঁধন-টাঁধন ছিঁড়ে, কতক লাফিয়ে কতক দৌড়িয়ে এক মুহূর্তের মধ্যে গভীর জঙ্গলের ভিতর মিলিয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে, ভয়ে ভয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড জন্তু--- সেটা কুমিরও নয়, সাপও নয়, মাছও নয়, অথচ তিনটারই কিছু আদল আছে--- সে এক হাত মস্ত হাঁ করে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে; আর একটা ছোটো নিরীহ গোছের কি যেন জানোয়ার হাত-পা এলিয়ে ঠিক তার মুখের সামনে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। আমরা মনে করলাম, এইবার বেচারাকে খাবে বুঝি, কিন্তু পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল, কেবল চীত্কারই চলতে লাগল; খাবার কোনো চেষ্টা দেখা গেল না। লক্কড় সিং বলল, ``আমি ওটাকে গুলি করি।'' আমি বললাম, ``কাজ নেই, গুলি যদি ঠিকমতো না লাগে, তা হলে জন্তুটা ক্ষেপে গিয়ে কি জানি করে বসবে, তা কে জানে?'' এই বলতে বলতেই ধেড়ে জন্তুটা চীত্কার থামিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে নদীর দিকে চলে গেল। চন্দ্রখাই বলল, ``এ জন্তুটার নাম দেওয়া যাক চিল্লানোসরাস্।'' ছক্কড় সিং বলল, ``উ বাচ্চাকো নাম দেও, বেচারাথেরিয়াম্।''
24 ৭ই সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে--- নদীর বাঁক ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পাহাড়ের একেবারে শেষ কিনারায় এসে পড়েছি। আর কোনোদিকে এগোবার জো নাই। দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়, সোজা দুশো তিনশো হাত নীচে সমতল জমি পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। যেদিকে তাকাই সেই দিকেই এরকম। নীচের যে সমতল জমি সে একেবারে মরুভূমির মতো; কোথাও গাছপালা, জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নাই। আমরা একেবারে পাহাড়ের কিনারায় ঝুঁকে পড়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় আমাদের ঠিক হাত পঞ্চাশেক নীচেই কি যেন ধড়্ফড়্ করে উঠল। দেখলাম বেশ একটা মাঝারি গোছের তিমি মাছের মতো মস্ত কি একটা জন্তু পাহাড়ের গায়ে আঁকড়ে ধরে বাদুড়ের মতো মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছে। তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে এইরকম আরো পাঁচ-সাতটা জন্তু দেখতে পেলাম। কোনোটা ঘাড় গুঁজে ঘুমাচ্ছে, কোনোটা লম্বা গলা ঝুলিয়ে দোল খাচ্ছে, আর অনেক দূরে একটা পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে কি যেন খুঁটে খুঁটে বের করে খাচ্ছে। এইরকম দেখছি এমন সময় হঠাত্ কট্ কটাং কট্ শব্দ করে সেই প্রথম জন্তুটা হুড়ুত্ করে ডানা মেলে একেবারে সোজা আমাদের দিকে উড়ে আসতে লাগল। ভয়ে আমাদের হাত-পাগুলো গুটিয়ে আসতে লাগল; এমন বিপদের সময়ে যে পালানো দরকার, তা পর্যন্ত আমরা ভুলে গেলাম। জন্তুটা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে আমাদের মাথার উপরে এসে পড়ল। তার পর যে কি হল তা আমার ভালো করে মনে নাই--- খালি একটু একটু মনে পড়ে, একটা অসম্ভব বিটকেল গন্ধের সঙ্গে ঝড়ের মতো ডানা ঝাপটানো আর জন্তুটার ভয়ানক কট্ কটাং আওয়াজ। একটুখানি ডানার ঝাপটা আমার গায়ে লেগেছিল তাতেই আমার দম বেরিয়ে প্রাণ বের হবার যোগাড় করেছিল। অন্যসকলের অবস্থাও সেইরকম অথবা তার চাইতেও খারাপ। যখন আমার হুঁশ হল তখন দেখি সকলেরই গা বেয়ে রক্ত পড়ছে। ছক্কড় সিং-এর একটা চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে, লক্কড় সিং-এর বাঁ হাতটা এমন মচকে গিয়েছে যে সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, আমারও সমস্ত বুকে পিঠে বেদনা ধরে গিয়েছে; কেবল চন্দ্রখাই এক হাতে রুমাল দিয়ে কপালের আর ঘাড়ের রক্ত মুছছে, আর-এক হাতে একমুঠো বিস্কুট নিয়ে খুব মন দিয়ে খাচ্ছে। আমরা তখনই আর বেশি আলোচনা না করে জিনিসপত্র গুটিয়ে বন্দাকুশ পাহাড়ের দিকে ফিরে চললাম।
26 [ প্রফেসর হুঁশিয়ারের ডায়েরি এইখানেই শেষ। কিন্তু আমরা আরো খবর জানবার জন্য তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম। তার উত্তরে তিনি তাঁর ভাগ্নেকে পাঠিয়ে দিয়ে লিখলেন, ``এর কাছেই সব খবর পাবে।'' চন্দ্রখাই-এর সঙ্গে আমাদের যে কথাবার্তা হয় খুব সংক্ষেপে তা হচ্ছে এই---
28 আমরা। আপনারা যে-সমস্ত নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন সে-সব কোথায় গেলে দেখতে পাওয়া যায়?
30 চন্দ্র। সে-সব হারিয়ে গেছে।
32 আমরা। বলেন কি! হারিয়ে গেল? এমন সব জিনিস হারিয়ে ফেললেন!
34 চন্দ্র। হ্যাঁ, প্রাণটুকু যে হারায় নি তাই যথেষ্ট। সে-দেশের ঝড় তো আপনারা দেখেন নি। তার এক-এক ঝাপটায় আমাদের যন্ত্রপাতি, বড়ো-বড়ো তাঁবু আর নমুনার বাক্স, সব কাগজের মতো হুস্ করে উড়িয়ে নেয়। আমাকেই তো পাঁচ-সাতবার উড়িয়ে নিয়েছিল। একবার তো ভাবলাম মরেই গেছি। কুকুরটাকে যে কোথায় উড়িয়ে নিল, সে তো আর খুঁজেই পেলাম না। সে যা বিপদ! কাঁটা কম্পাস, প্ল্যান ম্যাপ, খাতাপত্র কিছুই আর বাকি রাখে নি। কি করে যে ফিরলাম, তা শুনলে আপনার ঐ চুল দাড়ি সব সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠবে। আধপেটা খেয়ে, কোনোদিন না খেয়ে, আন্দাজে পথ চলে, দুই সপ্তাহের রাস্তা পার হতে আমাদের পুরো তিনমাস লেগেছিল।
36 আমরা। তা হলে আপনাদের প্রমাণ-টমান যা কিছু ছিল সব নষ্ট হয়েছে?
38 চন্দ্র। এই তো আমি রয়েছি, মামা রয়েছেন, আবার কি প্রমাণ চাই, আর এই আপনাদের জন্য কতকগুলো ছবি এঁকে এনেছি; এতেও অনেকটা প্রমাণ হবে।
40 আমাদের ছাপাখানার একটা ছোকরা ঠাট্টা করে বলল, ``আপনি কোন থেরিয়াম?'' আর-একজন বলল, ``উনি হচ্ছেন গপ্পথেরিয়াম--- বসে বসে গপ্প মারছেন।'' শুনে চন্দ্রখাই ভীষণ রেগে আমাদের টেবিল থেকে একমুঠো চীনেবাদাম আর গোটা আষ্টেক পান উঠিয়ে নিয়ে গজ্গজ্ করতে করতে বেরিয়ে গেল। ব্যাপার তো এই। এখন তোমরা কেউ যদি আরো জানতে চাও, তা হলে আমাদের ঠিকানায় প্রফেসর হুঁশিয়ারকে চিঠি লিখলে আমরা তার জবাব আনিয়ে দিতে পারি। ]
41 সন্দেশ, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য--- ১৩৩০
46 বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের উপর রুমালটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল ``ম্যাও!'' কি আপদ! রুমালটা ম্যাও করে কেন?
48 চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টক্টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
50 আমি বললাম, ``কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।''
52 অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, ``মুশকিল অবার কি? ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁক্পেঁকে হাঁস। এ তো হামেশাই হচ্ছে।''
54 আমি খানিক ভেবে বললাম, ``তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের বেড়াল নও, আসলে তুমি হচ্ছ রুমাল।''
56 বেড়াল বলল, ``বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পার।'' আমি বললাম, ``চন্দ্রবিন্দু কেন?''
58 শুনে বেড়ালটা ``তাও জানো না?'' বলে এক চোখ বুজে ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ চন্দ্রবিন্দুর কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ``ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।''
60 বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, ``হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে--- চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা--- হল চশমা। কেমন, হল তো?''
62 আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে বেড়ালটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত্ বলে উঠল, ``গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পার।''
64 আমি বললাম, ``বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না?''
66 বেড়াল বলল, ``কেন, সে আর মুশকিল কি?''
68 আমি বললাম, ``কি করে যেতে হয় তুমি জানো?''
70 বেড়াল একগাল হেসে বলল, ``তা আর জানি নে? কলকেতা, ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হল।''
72 আমি বললাম, ``'তা হলে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পার?''
74 শুনে বেড়ালটা হঠাত্ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, ``উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।''
76 আমি বললাম, ``গেছোদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?''
78 বেড়াল বলল, ``গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? গাছে থাকে।''
80 আমি বললাম, ``কোথায় গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়?''
82 বেড়াল খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।''
86 বেড়াল বলল, ``সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি। যদি মতিহারি যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবজার। কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।''
88 আমি বললাম, ``তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?''
90 বেড়াল বলল, ``সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে---''
92 আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ``সে কিরকম হিসেব?''
94 বেড়াল বলল, ``সে ভারি শক্ত। দেখবে কিরকম?'' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর গেছোদাদা।'' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
96 তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর তুমি,'' বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
98 তার পর হঠাত্ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর চন্দ্রবিন্দু।'' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, ``এই মনে কর তিব্বত---'' ``এই মনে কর গেছোবৌদি রান্না করছে---'' ``এই মনে কর গাছের গায়ে একটা ফুটো---''
100 এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, ``দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না।''
102 বেড়াল বলল, ``আচ্ছা, তা হলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোজ, আমি যা বলব, মনে মনে তার হিসেব কর।'' আমি চোখ বুজলাম।
104 চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, বেড়ালের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাত্ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি বেড়ালটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করে হাসছে।
106 কি আর করি, গাছতলায় একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম। বসতেই কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, ``সাত দুগুনে কত হয়?''
108 আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, ``কই জবাব দিচ্ছ না যে? সাত দুগুনে কত হয়?'' তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা দাঁড়কাক শ্লেট পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখছে, আর এক-একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
110 আমি বললাম, ``সাত দুগুনে চোদ্দো।''
112 কাকটা অমনি দুলে-দুলে মাথা নেড়ে বলল, ``হয় নি, হয় নি, ফেল্।''
114 আমার ভয়ানক রাগ হল। বললাম, ``নিশ্চয় হয়েছে। সাতেক্কে সাত, সাত দুগুনে চোদ্দো, তিন সাত্তে একুশ।''
116 কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল। তার পর বলল, ``সাত দুগুনে চোদ্দোর নামে চার, হাতে রইল পেনসিল!''
118 আমি বললাম, ``তবে যে বলছিলে সাত দুগুনে চোদ্দো হয় না? এখন কেন?''
120 কাক বলল, ``তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো চোদ্দো হয় নি। তখন ছিল, তেরো টাকা চোদ্দো আনা তিন পাই। আমি যদি ঠিক সময় বুঝে ধাঁ করে ১৪ লিখে না ফেলতাম, তা হলে এতক্ষণে হয়ে যেত চোদ্দো টাকা এক আনা নয় পাই।''
122 আমি বললাম, ``এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনি নি। সাত দুগুনে যদি চোদ্দো হয়, তা সে সব সময়েই চোদ্দো। একঘণ্টা আগে হলেও যা, দশদিন পরে হলেও তাই।''
124 কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, ``তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি?''
126 আমি বললাম, ``সময়ের দাম কিরকম?''
128 কাক বলল, ``এখানে কদিন থাকতে, তা হলে বুঝতে। আমাদের বাজারে সময় এখন ভয়ানক মাগ্যি, এতটুকু বাজে খরচ করবার জো নেই। এই তো কদিন খেটেখুটে চুরিচামারি করে খানিকটে সময় জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল।'' বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।
130 এমন সময়ে হঠাত্ গাছের একটা ফোকর থেকে কি যেন একটা সুড়ুত্ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল। চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ রঙের দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো তাতে কলকে-টলকে কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক। টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন কি-সব লিখেছে।
132 বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে হুঁকোতে দু-এক টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ``কই হিসেবটা হল?''
134 কাক খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, এই হল বলে।''
136 বুড়ো বলল, ``কি আশ্চর্য! উনিশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো হিসেবটা হয়ে উঠল না?''
138 কাক দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে পেনসিল চুষল তার পর জিজ্ঞাসা করল, ``কতদিন বললে?''
142 কাক অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, ``লাগ্ লাগ্ লাগ্ কুড়ি।''
144 বুড়ো বলল, ``একুশ।'' কাক বলল, ``বাইশ।'' বুড়ো বলল, ``তেইশ।'' কাক বলল, ``সাড়ে তেইশ।'' ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।
146 ডাকতে-ডাকতে কাকটা হঠাত্ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ``তুমি ডাকছ না যে?''
148 আমি বললাম, ``খামকা ডাকতে যাব কেন?''
150 বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাত্ আমার আওয়াজ শুনেই সে বন্বন্ করে আট দশ পাক ঘুরে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
152 তার পরে হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, ``খাড়াই ছাব্বিশ ইঞ্চি, হাতা ছাব্বিশ ইঞ্চি, আস্তিন ছাব্বিশ ইঞ্চি, ছাতি ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলা ছাব্বিশ ইঞ্চি।''
154 আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, ``এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি শুওর?''
156 বুড়ো বলল, ``বিশ্বাস না হয়, দেখ।''
158 দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায়।
160 তার পর বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, ``ওজন কত?''
162 আমি বললাম, ``জানি না!''
164 বুড়ো তার দুটো আঙুল দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে-টিপে বলল, ``আড়াই সের।''
166 আমি বললাম, ``সেকি, পট্লার ওজনই তো একুশ সের, সে আমার চাইতে দেড় বছরের ছোটো।''
168 কাকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ``সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।''
170 বুড়ো বলল, ``তা হলে লিখে নাও--- ওজন আড়াই সের, বয়েস সাঁইত্রিশ।''
172 আমি বললাম, ``দূত্! আমার বয়স হল আট বছর তিনমাস, বলে কিনা সাঁইত্রিশ।''
174 বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ``বাড়তি না কমতি?''
176 আমি বললাম, ``সে আবার কি?''
178 বুড়ো বলল, ``বলি বয়েসটা এখন বাড়ছে না কমছে?''
180 আমি বললাম, ``বয়েস আবার কমবে কি?''
182 বুড়ো বলল, ``তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি! কোনদিন দেখব বয়েস বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি বছর পার হয়ে গেছে। শেষটায় বুড়ো হয়ে মরি আর কি!''
184 আমি বললাম, ``তা তো হবেই। আশি বছর বয়েস হলে মানুষ বুড়ো হবে না!''
186 বুড়ো বলল, ``তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি বছর বয়েস হবে কেন? চল্লিশ বছর হলেই আমরা বয়েস ঘুরিয়ে দিই। তখন আর একচল্লিশ বেয়াল্লিশ হয় না--- উনচল্লিশ, আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে বয়েস নামতে থাকে। এমনি করে যখন দশ পর্যন্ত নামে তখন আবার বয়েস বাড়তে দেওয়া হয়। আমার বয়েস তো কত উঠল নামল আবার উঠল, এখন আমার বয়েস হয়েছে তেরো।'' শুনে আমার ভয়ানক হাসি পেয়ে গেল।
188 কাক বলল, ``তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্পট্ সেরে নি।''
190 বুড়ো অমনি চট্ করে আমার পাশে এসে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে ফিস্ফিস্ করে বলতে লাগল, ``একটা চমত্কার গল্প বলব। দাঁড়াও একটু ভেবে নি।'' এই বলে তার হুঁকো দিয়ে টেকো মাথা চুলকাতে-চুলকাতে চোখ বুজে ভাবতে লাগল। তার পর হঠাত্ বলে উঠল, ``হ্যাঁ, মনে হয়েছে, শোনো---
192 ``তার পর এদিকে বড়োমন্ত্রী তো রাজকন্যার গুলিসুতো খেয়ে ফেলেছে। কেউ কিচ্ছু জানে না। ওদিকে রাক্ষসটা করেছে কি, ঘুমুতে-ঘুমুতে হাঁউ-মাঁউ-কাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ বলে হুড়্ মুড়্ করে খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। অমনি ঢাক ঢোল সানাই কাঁশি লোক লস্কর সেপাই পল্টন হৈ-হৈ রৈ-রৈ মার্-মার্ কাট্-কাট্--- এর মধ্যে রাজামশাই বলে উঠলেন, `পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?' শুনে পাত্র মিত্র ডাক্তার মোক্তার আক্কেল মক্কেল সবাই বললে, `ভালো কথা! ন্যাজ কি হল?' কেউ তার জবাব দিতে পারে না, সুড়্সুড়্ করে পালাতে লাগল।''
194 এমন সময় কাকটা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ``বিজ্ঞাপন পেয়েছ? হ্যাণ্ডবিল?''
196 আমি বললাম, ``কই না, কিসের বিজ্ঞাপন?'' বলতেই কাকটা একটা কাগজের বাণ্ডিল থেকে একখানা ছাপানো কাগজ বের করে আমার হাতে দিল, আমি পড়ে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে---
197 শ্রীশ্রীভূশণ্ডিকাগায় নমঃ
198 শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে
199 ৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটি
201 আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী খুচরা ও পাইকারী সকলপ্রকার গণনার কার্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করিয়া থাকি। মূল্য এক ইঞ্চি ১৷৴৹। CHILDREN HALF PRICE অর্থাত্ শিশুদের অর্ধমূল্য। আপনার জুতার মাপ, গায়ের রঙ, কান কট্কট্ করে কি না, জীবিত কি মৃত, ইত্যাদি আবশ্যকীয় বিবরণ পাঠাইলেই ফেরত ডাকে ক্যাটালগ পাঠাইয়া থাকি।
202 সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!
204 আমরা সনাতন বায়সবংশীয় দাঁড়িকুলীন, অর্থাত্ দাঁড়কাক। আজকাল নানাশ্রেণীর পাতিকাক, হেঁড়েকাক, রামকাক প্রভৃতি নীচশ্রেণীর কাকেরাও অর্থলোভে নানারূপ ব্যবসা চালাইতেছে। সাবধান! তাহাদের বিজ্ঞাপনের চটক দেখিয়া প্রতারিত হইবেন না।
206 কাক বলল, ``কেমন হয়েছে?''
208 আমি বললাম, ``সবটা তো ভালো করে বোঝা গেল না।''
210 কাক গম্ভীর হয়ে বলল, ``হ্যাঁ, ভারি শক্ত, সকলে বুঝতে পারে না। একবার এক খদ্দের এয়েছিল তার ছিল টেকো মাথা---''
212 এই কথা বলতেই বুড়ো মাত্-মাত্ করে তেড়ে উঠে বলল, ``দেখ্! ফের যদি টেকো মাথা বলবি তো হুঁকো দিয়ে এক বাড়ি মেরে তোর শ্লেট ফাটিয়ে দেব।''
214 কাক একটু থতমত খেয়ে কি যেন ভাবল, তার পর বলল, ``টেকো নয়, টেপো মাথা, যে মাথা টিপে-টিপে টোল খেয়ে গিয়েছে।''
216 বুড়ো তাতেও ঠাণ্ডা হল না, বসে-বসে গজ্গজ্ করতে লাগল। তাই দেখে কাক বলল, ``হিসেবটা দেখবে নাকি?''
218 বুড়ো একটু নরম হয়ে বলল, ``হয়ে গেছে? কই দেখি।''
220 কাক অমনি ``এই দেখ'' বলে তার শ্লেটখানা ঠকাস্ করে বুড়োর টাকের উপর ফেলে দিল। বুড়ো তত্ক্ষণাত্ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল আর ছোটো ছেলেদের মতো ঠোট ফুলিয়ে ``ও মা, ও পিসি, ও শিবুদা'' বলে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগল।
222 কাকটা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে, বলল, ``লাগল নাকি! ষাট-ষাট।''
224 বুড়ো অমনি কান্না থামিয়ে বলল, ``একষট্টি, বাষট্টি, চৌষট্টি---''
226 কাক বলল, ``পঁয়ষট্টি।''
228 আমি দেখলাম আবার বুঝি ডাকাডাকি শুরু হয়, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ``কই হিসেবটা তো দেখলে না?''
230 বুড়ো বলল, ``হ্যাঁ-হ্যাঁ তাই তো! কি হিসেব হল পড় দেখি।''
232 আমি শ্লেটখানা তুলে দেখলাম ক্ষুদে-ক্ষুদে অক্ষরে লেখা রয়েছে---
234 ``ইয়াদি কির্দ অত্র কাকালতনামা লিখিতং শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে কার্যঞ্চাগে। ইমারত্ খেসারত্ দলিল দস্তাবেজ। তস্য ওয়ারিশানগণ মালিক দখলিকার সত্ত্বে অত্র নায়েব সেরেস্তায় দস্ত বদস্ত কায়েম মোকররী পত্তনীপাট্টা অথবা কাওলা কবুলিয়ত্। সত্যতায় কি বিনা সত্যতায় মুনসেফী আদালতে কিম্বা দায়রায় সোপর্দ আসামী ফরিয়াদী সাক্ষী সাবুদ গয়রহ মোকর্দমা দায়ের কিম্বা আপোস মকমল ডিক্রীজারী নিলাম ইস্তাহার ইত্যাদি সর্বপ্রকার কর্তব্য বিধায়---''
236 আমার পড়া শেষ না হতেই বুড়ো বলে উঠল, ``এ-সব কি লিখেছ আবোল তাবোল?''
238 কাক বলল, ``ও-সব লিখতে হয়। তা না হলে আদালতে হিসেব টিকবে কেন? ঠিক চৌকস-মতো কাজ করতে হলে গোড়ায় এ-সব বলে নিতে হয়।''
240 বুড়ো বলল, ``তা বেশ করেছ, কিন্তু আসল হিসেবটা কি হল তা তো বললে না?''
242 কাক বলল, ``হ্যাঁ, তাও তো বলা হয়েছে। ওহে, শেষ দিকটা পড় তো?''
244 আমি দেখলাম শেষের দিকে মোটা-মোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে---
246 সাত দুগুণে ১৪, বয়স ২৬ ইঞ্চি, জমা ৴২॥ সের, খরচ ৩৭ বত্সর।
248 কাক বলল, ``দেখেই বোঝা যাচ্ছে অঙ্কটা এল-সি-এম্ও নয়, জি-সি-এম্ও নয়। সুতরাং হয় এটা ত্রৈরাশিকের অঙ্ক, নাহয় ভগ্নাংশ। পরীক্ষা করে দেখলাম আড়াই সেরটা হচ্ছে ভগ্নাংশ। তা হলে বাকি তিনটে হল ত্রৈরাশিক। এখন আমার জানা দরকার, তোমরা ত্রৈরাশিক চাও না ভগ্নাংশ চাও?''
250 বুড়ো বলল, আচ্ছা দাঁড়াও, তা হলে একবার জিজ্ঞাসা করে নি।'' এই বলে সে নিচু হয়ে গাছের গোড়ায় মুখ ঠেকিয়ে ডাকতে লাগল, ``ওরে বুধো! বুধো রে!''
252 খানিক পরে মনে হল কে যেন গাছের ভিতর থেকে রেগে বলে উঠল, ``কেন ডাকছিস?''
254 বুড়ো বলল, ``কাক্কেশ্বর কি বলছে শোন্।''
256 আবার সেইরকম আওয়াজ হল, ``কি বলছে?''
258 বুড়ো বলল, ``বলছে, ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ?''
260 তেড়ে উত্তর হল, ``কাকে বলছে ভগ্নাংশ? তোকে না আমাকে?''
262 বুড়ো বলল, ``তা নয়। বলছে, হিসেবটা ভগ্নাংশ চাস, না ত্রৈরাশিক?''
264 একটুক্ষণ পর জবাব শোনা গেল, ``আচ্ছা, ত্রৈরাশিক দিতে বল।''
266 বুড়ো গম্ভীরভাবে খানিকক্ষণ দাড়ি হাতড়াল, তার পর মাথা নেড়ে বলল, ``বুধোটার যেমন বুদ্ধি! ত্রৈরাশিক দিতে বলব কেন? ভগ্নাংশটা খারাপ হল কিসে? না হে কাক্কেশ্বর, তুমি ভগ্নাংশই দাও।''
268 কাক বলল, ``তা হলে আড়াই সেরের গোটা সের দুটো বাদ গেলে রইল ভগ্নাংশ আধ সের, তোমার হিসেব হল আধ সের। আধ সের হিসেবের দাম পড়ে--- খাঁটি হলে দুটাকা চোদ্দোআনা, আর জল মেশানো থাকলে ছয় পয়সা।''
270 বুড়ো বলল, ``আমি যখন কাঁদছিলাম, তখন তিন ফোঁটা জল হিসেবের মধ্যে পড়েছিল। এই নাও তোমার শ্লেট, আর এই নাও পয়সা ছটা।''
272 পয়সা পেয়ে কাকের মহাফুর্তি! সে `টাক্-ডুমাডুম্ টাক্-ডুমাডুম্' বলে শ্লেট বাজিয়ে নাচতে লাগল।
274 বুড়ো অমনি আবার তেড়ে উঠল, ``ফের টাক-টাক বলছিস্? দাঁড়া। ওরে বুধো বুধো রে! শিগ্গির আয়। আবার টাক বলছে।'' বলতে-না-বলতেই গাছের ফোকর থেকে মস্ত একটা পোঁটলা মতন কি যেন হুড়্মুড়্ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। চেয়ে দেখলাম, একটা বুড়ো লোক একটা প্রকাণ্ড বোঁচকার নীচে চাপা পড়ে ব্যস্ত হয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে! বুড়োটা দেখতে অবিকল এই হুঁকোওয়ালা বুড়োর মতো। হুঁকোওয়ালা কোথায় তাকে টেনে তুলবে না সে নিজেই পোঁটলার উপর চড়ে বসে, ``ওঠ্ বলছি, শিগ্গির ওঠ্'' বলে ধাঁই-ধাঁই করে তাকে হুঁকো দিয়ে মারতে লাগল।
276 কাক আমার দিকে চোখ মট্কিয়ে বলল, ``ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? উধোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে। এর বোঝা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, এখন ও আর বোঝা ছাড়তে চাইবে কেন? এই নিয়ে রোজ মারামারি হয়।''
278 এই কথা বলতে-বলতেই চেয়ে দেখি, বুধো তার পোঁটলাসুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েই সে পোঁটলা উঁচিয়ে দাঁত কড়্মড়্ করে বলল, ``তবে রে ইস্টুপিড্ উধো!'' উধোও আস্তিন গুটিয়ে হুঁকো বাগিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, ``তবে রে লক্ষ্মীছাড়া বুধো!''
280 কাক বলল, ``লেগে যা, লেগে যা--- নারদ-নারদ!''
282 অমনি ঝটাপট্, খটাখট্, দমাদম্, ধপাধপ্! মুহূর্তের মধ্যে চেয়ে উধো চিত্পাত শুয়ে হাঁপাচ্ছে, আর বুধো ছট্ফট্ করে টাকে হাত বুলোচ্ছে।
284 বুধো কান্না শুরু করল, ``ওরে ভাই উধো রে, তুই এখন কোথায় গেলি রে?''
286 উধো কাঁদতে লাগল, ``ওরে হায় হায়! আমাদের বুধোর কি হল রে!''
288 তার পর দুজনে উঠে খুব খানিক গলা জড়িয়ে কেঁদে, আর খুব খানিক কোলাকুলি করে, দিব্যি খোশমেজাজে গাছের ফোকরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তাই দেখে কাকটাও তার দোকানপাট বন্ধ করে কোথায় যেন চলে গেল।
290 আমি ভাবছি এইবেলা পথ খুঁজে বাড়ি ফেরা যাক, এমন সময় শুনি পাশেই একটা ঝোপের মধ্যে কিরকম শব্দ হচ্ছে, যেন কেউ হাসতে হাসতে আর কিছুতেই হাসি সামলাতে পারছে না। উঁকি মেরে দেখি, একটা জন্তু--- মানুষ না বাঁদর, প্যাঁচা না ভূত, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না--- খালি হাত-পা ছুঁড়ে হাসছে, আর বলছে, ``এই গেল গেল--- নাড়ি-ভুঁড়ি সব ফেটে গেল!''
292 হঠাত্ আমায় দেখে সে একটু দম পেয়ে উঠে বলল, ``ভাগ্যিস তুমি এসে পড়লে, তা না হলে আর একটু হলেই হাসতে হাসতে পেত ফেটে যাচ্ছিল।''
294 আমি বললাম, ``তুমি এমন সাংঘাতিক রকম হাসছ কেন?''
296 জন্তুটা বলল, ``কেন হাসছি শুনবে? মনে কর, পৃথিবীটা যদি চ্যাপটা হত, আর সব জল গড়িয়ে ডাঙায় এসে এসে পড়ত, আর ডাঙার মাটি সব ঘুলিয়ে প্যাচ্প্যাচে কাদা হয়ে যেত, আর লোকগুলো সব তরা মধ্যে ধপাধপ্ আছাড় খেয়ে পড়ত, তা হলে--- হোঃ হোঃ হোঃ হো---'' এই বলে সে আবার হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল।
298 আমি বললাম, ``কি আশ্চর্য! এর জন্য তুমি এত ভয়ানক করে হাসছ?''
300 সে আবার হাসি থামিয়ে বলল, ``না, না, শুধু এর জন্য নয়। মনে কর, একজন লোক আসছে, তার এক হাতে কুলপিবরফ আর-এক হাতে সাজিমাটি, আর লোকটা কুলপি খেতে গিয়ে ভুলে সাজিমাটি খেয়ে ফেলেছে--- হোঃ হোঃ, হোঃ হো, হাঃ হাঃ হাঃ হা---'' আবার হাসির পালা।
302 আমি বললাম, ``কেন তুমি এই-সব অসম্ভব কথা ভেবে খামকা হেসে-হেসে কষ্ট পাচ্ছ?''
304 সে বলল, ``না, না, সব কি আর অসম্ভব? মনে কর, একজন লোক টিকটিকি পোষে, রোজ তাদের নাইয়ে খাইয়ে শুকোতে দেয়, একদিন একটা রামছাগল এসে সব টিকটিকি খেয়ে ফেলেছে--- হোঃ হোঃ হোঃ হো---''
306 জন্তুটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ``তুমি কে? তোমার নাম কি?''
308 সে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, ``আমার নাম হিজি বিজ্ বিজ্। আমার নাম হিজি বিজ্ বিজ্, আমার ভায়ের নাম হিজি বিজ্ বিজ্, আমার বাবার নাম হিজি বিজ্ বিজ্, আমার পিসের নাম হিজি বিজ্ বিজ্---''
310 আমি বললাম, ``তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবাই হিজি বিজ্ বিজ্।''
312 সে আবার খানিক ভেবে বলল, ``তা তো নয়, আমার নাম তকাই! আমার মামার নাম তকাই, আমার খুড়োর নাম তকাই, আমার মেসোর নাম তকাই, আমার শ্বশুরের নাম তকাই---''
314 আমি ধমক দিয়ে বললাম, ``সত্যি বলছ? না বানিয়ে?''
316 জন্তুটা কেমন থতমত খেয়ে বলল, ``না না, আমার শ্বশুরের নাম বিস্কুট।''
318 আমার ভয়ানক রাগ হল, তেড়ে বললাম, ``একটা কথাও বিশ্বাস করি না।''
320 অমনি কথা নেই বার্তা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে একটা মস্ত দাড়িওয়ালা ছাগল হঠাত্ উঁকি মেরে জিজ্ঞাসা করল, ``আমার কথা হচ্ছে বুঝি?''
322 আমি বলতে যাচ্ছিলাম `না' কিন্তু কিছু না বলতেই তড়্তড়্ করে সে বলে যেতে লাগল, ``তা তোমরা যতই তর্ক কর, এমন অনেক জিনিস আছে যা ছাগলে খায় না। তাই আমি একটা বক্তৃতা দিতে চাই, তার বিষয় হচ্ছে--- ছাগলে কি না খায়।'' এই বলে সে হঠাত্ এগিয়ে এসে বক্তৃতা আরম্ভ করল---
324 ``হে বালকবৃন্দ এবং স্নেহের হিজি বিজ্ বিজ্, আমার গলায় ঝোলানো সার্টিফিকেট দেখেই তোমরা বুঝতে পারছ যে আমার নাম শ্রী ব্যাকরণ শিং বি. এ. খাদ্যবিশারদ। আমি খুব চমত্কার ব্যা করতে পারি, তাই আমার নাম ব্যাকরণ, আর শিং তো দেখতেই পাচ্ছ। ইংরাজিতে লিখবার সময় লিখি B.A. অর্থাত্ ব্যা। কোন-কোন জিনিস খাওয়া যায় আর কোনটা-কোনটা খাওয়া যায় না, তা আমি সব নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি, তাই আমার উপাধি হচ্ছে খাদ্যবিশারদ। তোমরা যে বল--- পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়--- এটা অত্যন্ত অন্যায়। এই তো একটু আগে ঐ হতভাগাটা বলছিল যে রামছাগল টিকটিকি খায়! এটা এক্কেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমি অনেকরকম টিকটিকি চেটে দেখেছি, ওতে খাবার মতো কিচ্ছু নেই। অবশ্যি আমরা মাঝে-মাঝে এমন অনেক জিনিস খাই, যা তোমরা খাও না, যেমন--- খাবারের ঠোঙা, কিম্বা নারকেলের ছোবড়া, কিম্বা খবরের কাগজ, কিম্বা সন্দেশের মতো ভালো ভালো মাসিক পত্রিকা। কিন্তু তা বলে মজবুত বাঁধানো কোনো বই আমরা কক্ষনো খাই না। আমরা ক্বচিত্ কখনো লেপ কম্বল কিম্বা তোষক বালিশ এ-সব একটু আধটু খাই বটে, কিন্তু যারা বলে আমরা খাট পালং কিম্বা টেবিল চেয়ার খাই, তারা ভয়ানক মিথ্যাবাদী। যখন আমাদের মনে খুব তেজ আসে, তখন শখ করে অনেকরকম জিনিস আমরা চিবিয়ে কিম্বা চেখে দেখি, যেমন, পেনসিল রবার কিম্বা বোতলের ছিপি কিম্বা শুকনো জুতো কিম্বা ক্যামবিসের ব্যাগ। শুনেছি আমার ঠাকুরদাদা একবার ফুর্তির চোটে এক সাহেবের আধখানা তাঁবু প্রায় খেয়ে শেষ করেছিলেন। কিন্তু তা বলে ছুরি কাঁচি কিম্বা শিশি-বোতল, এ-সব আমরা কোনোদিন খাই না। কেউ-কেউ সাবান খেতে ভালোবাসে, কিন্তু সে-সব নেহাত ছোটোখাটো বাজে সাবান। আমার ছোটভাই একবার একটা আস্ত বার্-সোপ খেয়ে ফেলেছিল---'' বলেই ব্যাকরণ শিং আকাশের দিকে চোখ তুলে ব্যা-ব্যা করে ভয়ানক কাঁদতে লাগল। তাতে বুঝতে পারলাম যে সাবান খেয়ে ভাইটির অকালমৃত্যু হয়েছিল।
326 হিজি বিজ্ বিজ্টা এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, হঠাত্ ছাগলটার বিকট কান্না শুনে সে হাঁউ-মাঁউ করে ধড়্মড়িয়ে উঠে বিষম-টিষম খেয়ে একেবারে অস্থির! আমি ভাবলাম বোকাটা বুঝি মরে এবার! কিন্তু একটু পরেই দেখি, সে আবার তেমনি হাত-পা ছুঁড়ে ফ্যাক্ফ্যাক্ করে হাসতে লেগেছে।
328 আমি বললাম, ``এর মধ্যে আবার হাসবার কি হল?''
330 সে বলল, ``সেই একজন লোক ছিল, সে মাঝে-মাঝে এমন ভয়ংকর নাক ডাকাত যে সবাই তার উপর চটা ছিল! একদিন তাদের বাড়ি বাজ পড়েছে, আর অমনি সবাই দৌড়ে তাকে দমাদম মারতে লেগেছে--- হোঃ হোঃ হোঃ হো---'' আমি বললাম, ``যত-সব বাজে কথা।'' এই বলে যেই ফিরতে গেছি, অমনি চেয়ে দেখি একটা নেড়ামাথা কে-যেন যাত্রার জুড়ির মতো চাপকান আর পায়জামা পরে হাসি-হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে আমার গা জ্বলে গেল। আমায় ফিরতে দেখেই সে আবদার করে আহ্লাদীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে দুহাত নেড়ে বলতে লাগল, ``না ভাই, না ভাই, এখন আমায় গাইতে বোলো না। সত্যি বলছি, আজকে আমার গলা তেমন খুলবে না।''
332 আমি বললাম, ``কি আপদ! কে তোমায় গাইতে বলছে?''
334 লোকটা এমন বেহায়া, সে তবুও আমার কানের কাছে ঘ্যান্ঘ্যান্ করতে লাগল, ``রাগ করলে? হ্যাঁ ভাই, রাগ করলে? আচ্ছা নাহয় কয়েকটা গান শুনিয়ে দিচ্ছি, রাগ করবার দরকার কি ভাই?''
336 আমি কিছু বলবার আগেই ছাগলটা আর্ হিজি বিজ্ বিজ্টা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ``হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ, গান হোক, গান হোক।'' অমনি নেড়াটা তার পকেট থেকে মস্ত দুই তাড়া গানের কাগজ বার করে, সেগুলো চোখের কাছে নিয়ে গুনগুন করতে করতে হঠাত্ সরু গলায় চীত্কার করে গান ধরল--- ``লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ।''
338 ঐ একটিমাত্র পদ সে একবার গাইল, দুবার গাইল, পাঁচবার, দশবার গাইল।
340 আমি বললাম, ``এ তো ভারি উত্পাত দেখছি, গানের কি আর কোনো পদ নেই?''
342 নেড়া বলল, ``হ্যাঁ আছে, কিন্তু সেটা অন্য একটা গান। সেটা হচ্ছে--- অলিগলি চলি রাম, ফুটপাথে ধুমধাম, কালি দিয়ে চুনকাম। সে গান আজকাল আমি গাই না। আরেকটা গান আছে--- নাইনিতালের নতুন আলু--- সেটা খুব নরম সুরে গাইতে হয়। সেটাও আজকাল গাইতে পারি না। আজকাল যেটা গাই, সেটা হচ্ছে শিখিপাখার গান।'' এই বলে সে গান ধরল---
345 মিশিপাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে
346 শিশি বোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে
347 আলাভোলা বাঁকা আলো আধো আধো কতদূরে,
348 সরু মোটা সাদা কালো ছলছল ছায়াসুরে।
350 আমি বললাম, ``এ আবার গান হল নাকি? এর তো মাথামুণ্ডু কোনো মানেই হয় না।''
352 হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, ``হ্যাঁ, গানটা ভারি শক্ত।''
354 ছাগল বলল, ``শক্ত আবার কোথায়? ঐ শিশি বোতলের জায়গাটা একটু শক্ত ঠেকল, তা ছাড়া তো শক্ত কিছু পেলাম না।''
356 নেড়াটা খুব অভিমান করে বলল, ``তা, তোমরা সহজ গান শুনতে চাও তো সে কথা বললেই হয়। অত কথা শোনাবার দরকার কি? আমি কি আর সহজ গান গাইতে পারি না?'' এই বলে সে গান ধরল---
359 বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু,
360 আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু।
362 আমি বললাম, ``মজারু বলে কোনো-একটা কথা হয় না।''
364 নেড়া বলল, ``কেন হবে না--- আলবত্ হয়। সজারু কাঙ্গারু দেবদারু সব হতে পারে, মজারু কেন হবে না?''
366 ছাগল বলল, ``ততক্ষণ গানটা চলুক-না, হয় কি না হয় পরে দেখা যাবে।'' অমনি আবার গান শুরু হল---
369 বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু,
370 আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু।
371 আজকে হেথায় চাম্চিকে আর পেঁচারা
372 আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা।
373 কাঁপবে ভয়ে ব্যাঙগুলো আর ব্যাঙাচি,
374 ঘামতে ঘামতে ফুটবে তাদের ঘামাচি,
375 ছুটবে ছুঁচো লাগবে দাঁতে কপাটি,
376 দেখবে তখন ছিম্বি ছ্যাঙা চপাটি।
378 আমি আবার আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সামলে গেলাম। গান আবার চলতে লাগল,
381 সজারু কয়, ঝোপের মাঝে এখনি
382 গিন্নী আমার ঘুম দিয়েছেন দেখ নি?
383 এনে রাখুন প্যাঁচা এবং প্যাঁচানি,
384 ভাঙলে সে ঘুম শুনে তাদের চ্যাঁচানি,
385 খ্যাংরা-খোঁচা করব তাদের খুঁচিয়ে---
386 এই কথাটা বলবে তুমি বুঝিয়ে।
387 বাদুড় বলে, পেঁচার কুটুম কুটুমী,
388 মানবে না কেউ তোমার এ-সব ঘুঁতুমি।
389 ঘুমোয় কি কেউ এমন ভুসো আঁধারে?
390 গিন্নী তোমার হোঁত্লা এবং হাঁদাড়ে।
391 তুমিও দাদা হচ্ছ ক্রমে খ্যাপাটে
392 চিমনি-চাটা ভোঁপসা-মুখো ভ্যাঁপাটে।
394 গানটা আরো চলত কি না জানি না, কিন্তু এইপর্যন্ত হতেই একটা গোলমাল শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি আমার আশেপাশে চারদিকে ভিড় জমে গিয়েছে। একটা সজারু এগিয়ে বসে ফোঁত্ ফোঁত্ করে কাঁদছে আর একটা শাম্লাপরা কুমির মস্ত একটা বই নিয়ে আস্তে-আস্তে তার পিঠ থাবড়াচ্ছে আর ফিস্ফিস্ করে বলছে, ``কেঁদো না, কেঁদো না, সব ঠিক করে দিচ্ছি।'' হঠাত্ একটা তক্মা-আঁটা পাগড়ি-বাঁধা কোলাব্যাঙ রুল উঁচিয়ে চীত্কার করে বলে উঠল--- ``মানহানির মোকদ্দমা।''
396 অমনি কোত্থেকে একটা কালো ঝোল্লা-পরা হুতোমপ্যাঁচা এসে সকলের সামনে একটা উঁচু পাথরের উপর বসেই চোখ বুজে ঢুলতে লাগল, আর একটা মস্ত ছুঁচো একটা বিশ্রী নোংরা হাতপাখা দিয়ে তাকে বাতাস করতে লাগল।
398 প্যাঁচা একবার ঘোলা-ঘোলা চোখ করে চারদিকে তাকিয়েই তক্ষুনি আবার চোখ বুজে বলল, ``নালিশ বাতলাও।''
400 বলতেই কুমিরটা অনেক কষ্টে কাঁদো-কাঁদো মুখ করে চোখের মধ্যে নখ দিয়ে খিমচিয়ে পাঁচ ছয় ফোঁটা জল বার করে ফেলল। তার পর সর্দিবসা মোটা গলায় বলতে লাগল, ``ধর্মাবতার হুজুর! এটা মানহানির মোকদ্দমা। সুতরাং প্রথমেই বুঝতে হবে মান কাকে বলে। মান মানে কচু। কচু অতি উপাদেয় জিনিস। কচু অনেকপ্রকার, যথা--- মানকচু, ওলকচু, কান্দাকচু, মুখিকচু, পানিকচু, শঙ্খকচু, ইত্যাদি। কচুগাছের মূলকে কচু বলে, সুতরাং বিষয়টার একেবারে মূল পর্যন্ত যাওয়া দরকার।''
402 এইটুকু বলতেই একটা শেয়াল শাম্লা মাথায় তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে বলল, ``হুজুর, কচু অতি অসার জিনিস। কচু খেলে গলা কুট্কুট্ করে, কচুপোড়া খাও বললে মানুষ চটে যায়। কচু খায় কারা? কচু খায় শুওর আর সজারু। ওয়াক্ থুঃ।'' সজারুটা আবার ফ্যাঁত্ফ্যাঁত্ করে কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুমির সেই প্রকাণ্ড বই দিয়ে তার মাথায় এক থাবড়া মেরে জিজ্ঞাসা করল, ``দলিলপত্র সাক্ষী-সাবুদ কিছু আছে?'' সজারু নেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ``ঐ তো ওর হাতে সব দলিল রয়েছে।'' বলতেই কুমিরটা নেড়ার কাছ থেকে একতাড়া গানের কাগজ কেড়ে নিয়ে হঠাত্ এক জায়গা থেকে পড়তে লাগল---
405 একের পিঠে দুই গোলাপ চাঁপা জুঁই সান্ বাঁধানো ভুঁই
406 চৌকি চেপে শুই ইলিশ মাগুর রুই গোবর জলে ধুই
407 পোঁটলা বেঁধে থুই হিন্চে পালং পুঁই কাঁদিস কেন তুই।
409 সজারু বলল, ``আহা ওটা কেন? ওটা তো নয়।'' কুমির বলল, ``তাই নাকি? আচ্ছা দাঁড়াও।'' এই বলে সে আবার একখানা কাগজ নিয়ে পড়তে লাগল---
412 চাঁদনি রাতের পেতনীপিসি সজনেতলায় খোঁজ্ না রে---
413 থ্যাঁতলা মাথা হ্যাংলা সেথা হাড় কচাকচ্ ভোজ মারে।
414 চালতা গাছে আল্তা পরা নাক ঝুলানো শাঁখচুনি
415 মাক্ড়ি নেড়ে হাঁকড়ে বলে, আমায় তো কেঁউ ডাঁকছ নি!
416 মুণ্ডু ঝোলা উল্টোবুড়ি ঝুলছে দেখ চুল খুলে,
417 বলছে দুলে, মিন্সেগুলোর মাংস খাব তুলতুলে।
419 সজারু বলল, ``দূর ছাই! কি যে পড়ছে তার নেই ঠিক।''
421 কুমির বলল, ``তাহলে কোনটা, এইটা?--- দই দম্বল, টেকো অম্বল, কাঁথা কম্বল করে সম্বল বোকা ভোম্বল--- এটাও নয়? আচ্ছা তা হলে দাঁড়াও দেখছি--- নিঝুম নিশুত রাতে, একা শুয়ে তেতালাতে, খালি খালি খিদে পায় কেন রে?--- কি বললে?--- ও-সব নয়? তোমার গিন্নীর নামে কবিতা?--- তা সে কথা আগে বললেই হত। এই তো--- রামভজনের গিন্নীটা, বাপ রে যেন সিংহীটা! বাসন নাড়ে ঝনার্ঝন, কাপড় কাচে দমাদ্দম্।--- এটাও মিলছে না? তা হলে নিশ্চয় এটা---
424 খুস্খুসে কাশি ঘুষ্ঘুষে জ্বর, ফুস্ফুসে ছ্যাঁদা বুড়ো তুই মর্।
425 মাজ্রাতে ব্যথা পাঁজ্রাতে বাত, আজ রাতে বুড়ো হবি কুপোকাত!''
427 সজারুটা ভয়ানক কাঁদতে লাগল, ``হায়, হায়! আমার পয়সাগুলো সব জলে গেল! কোথাকার এক আহাম্মক উকিল, দলিল খুঁজে পায় না!''
429 নেড়াটা এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে ছিল, সে হঠাত্ বলে উঠল, ``কোনটা শুনতে চাও? সেই যে--- বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু--- সেইটে?''
431 সজারু ব্যস্ত হয়ে বলল, ``হ্যাঁ-হ্যাঁ, সেইটে, সেইটে।''
433 অমনি শেয়াল আবার তেড়ে উঠল, ``বাদুড় কি বলে? হুজুর, তা হলে বাদুড়গোপালকে সাক্ষী মানতে আজ্ঞা হোক।''
435 কোলাব্যাঙ গাল-গলা ফুলিয়ে হেঁকে বলল, ``বাদুড়গোপাল হাজির?''
437 সবাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, কোথাও বাদুড় নেই। তখন শেয়াল বলল, ``তা হলে হুজুর, ওদের সক্কলের ফাঁসির হুকুম হোক।''
439 কুমির বলল, ``তা কেন? এখন আমরা আপিল করব?''
441 প্যাঁচা চোখ বুজে বলল, ``আপিল চলুক! সাক্ষী আন।''
443 কুমির এদিক-ওদিক তাকিয়ে হিজি বিজ্ বিজ্কে জিজ্ঞাসা করল, ``সাক্ষী দিবি? চার আনা পয়সা পাবি।'' পয়সার নামে হিজি বিজ্ বিজ্ তড়াক্ করে সাক্ষী দিতে উঠেই ফ্যাক্ফ্যাক্ করে হেসে ফেলল।
445 শেয়াল বলল, ``হাসছ কেন?''
447 হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, ``একজনকে শিখিয়ে দিয়েছিল, তুই সাক্ষী দিবি যে, বইটার সবুজ রঙের মলাট, কানের কাছে নীল চামড়া আর মাথার উপর লালকালির ছাপ। উকিল যেই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তুমি আসামীকে চেন? অমনি সে বলে উঠেছে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সবুজ রঙের মলাট, কানের কাছে নীল চামড়া, মাথার উপর লালকালির ছাপ--- হোঃ হোঃ হোঃ হো---''
449 শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, ``তুমি সজারুকে চেন?''
451 হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, ``হ্যাঁ, সজারু চিনি, কুমির চিনি, সব চিনি। সজারু গর্তে থাকে, তার গায়ে লম্বা-লম্বা কাঁটা, আর কুমিরের গায়ে চাকা-চাকা ঢিপির মতো, তারা ছাগল-টাগল ধরে খায়।'' বলতেই ব্যাকরণ শিং ব্যা-ব্যা করে ভয়ানক কেঁদে উঠল।
453 আমি বললাম, ``আবার কি হল?''
455 ছাগল বলল, ``আমার সেজোমামার আধখানা কুমিরে খেয়েছিল, তাই বাকি আধখানা মরে গেল।''
457 আমি বললাম, ``গেল তো গেল, আপদ গেল। তুমি এখন চুপ কর।''
459 শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, ``তুমি মোকদ্দমার কিছূ জানো?''
461 হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, ``তা আর জানি নে? একজন নালিশ করে তার একজন উকিল থাকে, আর একজনকে আসাম থেকে ধরে নিয়ে আসে, তাকে বলে আসামী। তারও একজন উকিল থাকে। এক-একদিকে দশজন করে সাক্ষী থাকে! আর একজন জজ থাকে, সে বসে-বসে ঘুমোয়।''
463 প্যাঁচা বলল, ``কক্ষনো আমি ঘুমোচ্ছি না, আমার চোখে ব্যারাম আছে তাই চোখ বুজে আছি।''
465 হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, ``আরো অনেক জজ দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম।'' বলেই সে ফ্যাক্ফ্যাক্ করে ভয়ানক হাসতে লাগল।
467 শেয়াল বলল, ``আবার কি হল?''
469 হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, ``একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, তার ছাতার নাম ছিল প্রত্যুত্পন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু--- কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে। হোঃ হোঃ হোঃ হো---''
471 শেয়াল বলল, ``বটে? তোমার নাম কি শুনি?''
473 সে বলল, ``এখন আমার নাম হিজি বিজ্ বিজ্।''
475 শেয়াল বলল, ``নমের আবার এখন আর তখন কি?''
477 হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, ``তাও জানো না? সকালে আমার নাম থাকে আলুনারকোল আবার আর একটু বিকেল হলেই আমার নাম হয়ে যাবে রামতাড়ু।''
479 শেয়াল বলল, ``নিবাস কোথায়?''
481 হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, ``কার কথা বলছ? শ্রীনিবাস? শ্রীনিবাস দেশে চলে গিয়েছে।'' অমনি ভিড়ের মধ্যে থেকে উধো আর বুধো একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ``তা হলে শ্রীনিবাস নিশ্চয়ই মরে গিযেছে!''
483 উধো বলল, ``দেশে গেলেই লোকেরা সব হুস্হুস্ করে করে মরে যায়।''
485 বুধো বলল, ``হাবুলের কাকা যেই দেশে গেল অমনি শুনি সে মরে গিয়েছে।''
487 শেয়াল বলল, ``আঃ, সবাই মিলে কথা বোলো না, ভারি গোলমাল হয়।''
489 শুনে উধো বুধোকে বলল, ``ফের সবাই মিলে কথা বলবি তো তোকে মারতে মারতে সাবাড় করে ফেলব।'' বুধো বলল, ``আবার যদি গোলমাল করিস তা হলে তোকে ধরে এক্কেবারে পোঁটলা-পেটা করে দেব।''
491 শেয়াল বলল, ``হুজুর, এরা সব পাগল আর আহাম্মক, এদের সাক্ষীর কোনো মূল্য নেই।''
493 শুনে কুমির রেগে ল্যাজ আছড়িয়ে বলল, ``কে বলল মূল্য নেই? দস্তুরমতো চার আনা পয়সা খরচ করে সাক্ষী দেওয়ানো হচ্ছে।'' বলেই সে তক্ষুনি ঠক্ঠক্ করে ষোলোটা পয়সা গুণে হিজি বিজ্ বিজের হাতে দিয়ে দিল।
495 অমনি কে যেন ওপর থেকে বলে উঠল, ``১নং সাক্ষী, নগদ হিসাব, মূল্য চার আনা।'' চেয়ে দেখলাম কাক্কেশ্বর বসে-বসে হিসেব লিখছে।
497 শেয়াল আবার জিজ্ঞাসা করল, ``তুমি এ বিষয়ে আর কিছু জানো কি-না?''
499 হিজি বিজ্ বিজ্ খানিক ভেবে বলল, ``শেয়ালের বিষয়ে একটা গান আছে, সেইটা জানি।''
501 শেয়াল বলল, ``কি গান শুনি?''
503 হিজি বিজ্ বিজ্ সুর করে বলতে লাগল, ``আয়, আয়, আয়, শেয়ালে বেগুন খায়, তারা তেল আর নুন কোথায় পায়---''
505 বলতেই শেয়াল ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে উঠল, ``থাক্-থাক্, সে অন্য শেয়ালের কথা, তোমার সাক্ষী দেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে।''
507 এদিকে হয়েছে কি, সাক্ষীরা পয়সা পাচ্ছে দেখে সাক্ষী দেবার জন্য ভয়ানক হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছে। সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করছে, এমন সময় হঠাত্ দেখি কাক্কেশ্বর ঝুপ্ করে গাছ থেকে নেমে এসে সাক্ষীর জায়গায় বসে সাক্ষী দিতে আরম্ভ করেছে। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই সে বলতে আরম্ভ করল, ``শ্রীশ্রীভূশণ্ডীকাগায় নমঃ। শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে, ৪১নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটি। আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী খুচরা পাইকারী সকলপ্রকার গণনার কার্য---''
509 শেয়াল বলল, ``বাজে কথা বোলো না, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও। কি নাম তোমার?''
511 কাক বলল, ``কি আপদ! তাই তো বলছিলাম--- শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে।''
513 শেয়াল বলল, ``নিবাস কোথায়?''
515 কাক বলল, ``বললাম যে কাগেয়াপটি।''
517 শেয়াল বলল, ``সে এখান থেকে কতদূর?''
519 কাক বলল, ``তা বলা ভারি শক্ত। ঘণ্টা হিসেবে চার আনা, মাইল হিসাবে দশ পয়সা, নগদ দিলে দুই পয়সা কম। যোগ করলে দশ আনা, বিয়োগ করলে তিন আনা, ভাগ করলে সাত পয়সা, গুণ করলে একুশ টাকা।''
521 শেয়াল বলল, ``আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না। জিজ্ঞাসা করি, তোমার বাড়ি যাবার পথটা চেন তো?''
523 কাক বলল, ``তা আর চিনি নে? এই তো সামনেই সোজা পথ দেখা যাচ্ছে।''
525 শেয়াল বলল, ``এ-পথ কতদূর গিয়েছে?''
527 কাক বলল, ``পথ আবার কোথায় যাবে? যেখানকার পথ সেখানেই আছে। পথ কি আবার এদিক-ওদিক চরে বেড়ায়? না, দার্জিলিঙে হাওয়া খেতে যায়?''
529 শেয়াল বলল, ``তুমি তো ভারি বেয়াদব হে! বলি, সাক্ষী দিতে যে এয়েছ, মোকদ্দমার কথা কি জানো?''
531 কাক বলল, ``খুব যা হোক! এতক্ষণ বসে-বসে হিসেব করল কে? যা কিছু জানতে চাও আমার কাছে পাবে। এই তো প্রথমেই, মান কাকে বলে? মান মানে কচুরি। কচুরি চারপ্রকার--- হিঙে কচুরি, খাস্তা কচুরি নিমকি আর জিবেগজা! খেলে কি হয়? খেলে শেয়ালদের গলা কুট্কুট্ করে, কিন্তু কাগেদের করে না। তার পর একজন সাক্ষী ছিল, নগদ মূল্য চার আনা, সে আসামে থাকত, তার কানের চামড়া নীল হয়ে গেল--- তাকে বলে কালাজ্বর। তার পর একজন লোক ছিল সে সকলের নামকরণ করত--- শেয়ালকে বলত তেলচোরা, কুমিরকে বলত অষ্টাবক্র, প্যাঁচাকে বলত বিভীষণ---'' বলতেই বিচার সভায় একটা ভয়ানক গোলমাল বেধে গেল। কুমির হঠাত্ খেপে গিয়ে টপ্ করে কোলাব্যাঙকে খেয়ে ফেলল, তাই দেখে ছুঁচোটা কিচ্ কিচ্ কিচ্ কিচ্ করে ভয়ানক চেঁচাতে লাগল, শেয়াল একটা ছাতা দিয়ে হুস্ হুস্ করে কাক্কেশ্বরকে তাড়াতে লাগল।
533 প্যাঁচা গম্ভীর হয়ে বলল, ``সবাই চুপ কর, আমি মোকদ্দমার রায় দেব।'' এই বলেই কানে-কলম-দেওয়া খরগোশকে হুকুম করল, ``যা বলছি লিখে নাও: মানহানির মোকদ্দমা, চব্বিশ নম্বর। ফরিয়াদী--- সজারু। আসামী---দাঁড়াও। আসামী কই?'' তখন সবাই বল, ``ঐ যা! আসামী তো কেউ নেই।'' তাড়াতাড়ি ভুলিয়ে-ভালিয়ে নেড়াকে আসামী দাঁড় করানো হল। নেড়াটা বোকা, সে ভাবল আসামীরাও বুঝি পয়সা পাবে, তাই সে কোনো আপত্তি করল না।
535 হুকুম হল--- নেড়ার তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি। আমি সবে ভাবছি এরকম অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে আপত্তি করা উচিত, এমন সময় ছাগলটা হঠাত্ ``ব্যা-করণ শিং'' বলে পিছন থেকে তেড়ে এসে আমায় এক ঢুঁ মারল, তার পরেই আমার কান কামড়ে দিল। অমনি চারদিকে কিরকম সব ঘুলিয়ে যেতে লাগল, ছাগলটার মুখটা ক্রমে বদলিয়ে শেষটায় ঠিক মেজোমামার মতো হয়ে গেল। তখন ঠাওর করে দেখলাম, মেজোমামা আমার কান ধরে বলছেন, ``ব্যাকরণ শিখবার নাম করে বুঝি পড়ে-পড়ে ঘুমোনো হচ্ছে?''
537 আমি তো অবাক! প্রথমে ভাবলাম বুঝি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু, তোমরা বললে বিশ্বাস করবে না, আমার রুমালটা খুঁজতে গিয়ে দেখি কোথাও রুমাল নেই, আর একটা বেড়াল বেড়ার ওপর বসে বসে গোঁফে তা দিচ্ছিল, হঠাত্ আমায় দেখতে পেয়েই খচ্মচ্ করে নেমে পালিয়ে গেল। আর ঠিক সেই সময়ে বাগানের পিছন থেকে একটা ছাগল ব্যা করে ডেকে উঠল।
539 আমি বড়োমামার কাছে এ-সব কথা বলেছিলাম, কিন্তু বড়োমামা বললেন, ``যা, যা, কতগুলো বাজে স্বপ্ন দেখে তাই নিয়ে গল্প করতে এসেছে।'' মানুষের বয়স হলে এমন হোঁতকা হয়ে যায়, কিছুতেই কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায় না। তোমাদের কিনা এখনো বেশি বয়স হয়নি, তাই তোমাদের কাছে ভরসা করে এ-সব কথা বললাম।
540 সন্দেশ--- জৈষ্ঠ্য-ভাদ্র, ১৩২৯
542 আমাদের স্কুলের যত ছাত্র তাহার মধ্যে এমন কেহই ছিল না, যে পাগলা দাশুকে না চিনে। যে লোক আর কাহাকেও জানে না, সেও সকলের আগে পাগলা দাশুকে চিনিয়া লয়। সেবার একজন নূতন দারোয়ান আসিল, একেবারে আনকোরা পাড়াগেঁয়ে লোক, কিন্তু প্রথম যখন সে পাগলা দাশুর নাম শুনিল, তখনই সে আন্দাজে ঠিক ধরিয়া লইল যে, এই ব্যক্তিই পাগলা দাশু। কারণ তার মুখের চেহারায়, কথাবার্তায়, চলনে চালনে বোঝা যাইত যে তাহার মাথায় একটু `ছিট' আছে। তাহার চোখদুটি গোল-গোল, কানদুটা অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় এক বস্তা ঝাঁকড়া চুল। চেহারাটা দেখিলেই মনে হয়---
545 ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী
546 যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী।
548 সে যখন তাড়াতাড়ি চলে অথবা ব্যস্ত হইয়া কথা বলে, তখন তাহার হাত-পা ছোঁড়ার ভঙ্গি দেখিয়া হঠাত্ চিংড়িমাছের কথা মনে পড়ে।
550 সে যে বোকা ছিল তাহা নয়। অঙ্ক কষিবার সময়, বিশেষত লম্বা-লম্বা গুণ-ভাগের বেলায় তার আশ্চর্য মাথা খুলিত। আবার এক-এক সময় সে আমাদের বোকা বানাইয়া তামাশা দেখিবার জন্য এমন সকল ফন্দি বাহির করিত, যে আমরা তাহার বুদ্ধি দেখিয়া অবাক হইয়া থাকিতাম।
552 দাশু, অর্থাত্ দাশরথি, যখন প্রথম আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়, তখন জগবন্ধুকে আমাদের ক্লাশের `ভালো ছেলে' বলিয়া সকলে জানিত। সে পড়াশুনায় ভালো হইলেও, তাহার মতো অমন একটি হিংসুটে ভিজেবেড়াল আমরা আর দেখি নাই। দাশু একদিন জগবন্ধুর কাছে কি একটা ইংরাজি পড়া জিজ্ঞাসা করিতে গিয়াছিল। জগবন্ধু পড়া বলিয়া দেওয়া দূরে থাকুক, তাহাকে বেশ দু কথা শোনাইয়া বলিল, ``আমার বুঝি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আজ এঁকে ইংরিজি বোঝাব, কাল ওঁর অঙ্ক কষে দেব, পরশু আরেকজন আসবেন আরেক ফরমাইস নিয়ে--- ঐ করি আর কি!'' দাশু সাংঘাতিক চটিয়া বলিল, ``তুমি তো ভারি চ্যাঁচড়া ছোটোলোক হে!'' জগবন্ধু পণ্ডিতমহাশয়ের কাছে নালিশ করিল, ঐ নতুন ছেলেটা আমাকে গালাগালি দিচ্ছে।'' পণ্ডিতমহাশয় দাশুকে এমনি দু-চার ধমক দিয়া দিলেন যে, সে বেচারা একেবারে দমিয়া গেল।
554 তার পর কয়দিন দাশু জগবন্ধুর সহিত কথাবার্তা কহে নাই। পণ্ডিতমহাশয় রোজ ক্লাশে আসেন, আর যখন দরকার হয়, জগবন্ধুর কাছে বই চাহিয়া লন। একদিন তিনি পড়াইবার সময় উপক্রমণিকা চাহিলেন, জগবন্ধু তা।ড়াতাড়ি তাহার সবুজ কাপড়ের মলাট দেওয়া উপক্রমণিকাখানা বাহির করিয়া দিল। পণ্ডিতমহাশয় বইখানি খুলিয়াই হথাত্ গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ``বইখানা কার?'' জগবন্ধু বুক ফুলাইয়া বলিল, ``আমার।'' পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, ``হুঁ---নূতন সংস্করণ বুঝি? বইকে বই একেবারে বদলে গেছে।'' এই বলিয়া তিনি পড়িতে লাগিলেন, ``যশোবন্ত দারোগা--- লোমহর্ষক ডিটেক্টিভ নাটক।'' জগবন্ধু ব্যাপারখানা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মতো তাকাইয়া রহিল। পণ্ডিতমহাশয় বিকটরকম চোখ পাকাইয়া বলিলেন, ``স্কুলে আমার আদুরে গোপাল, আর বাড়িতে বুঝি নৃসিংহ অবতার?'' জগবন্ধু আম্তা-আম্তা করিয়া কি যেন বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু পণ্ডিতমহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, ``থাক, থাক, আর ভালোমানুষি দেখিয়ে কাজ নেই---ঢের হয়েছে।'' লজ্জায়, অপমানে জগবন্ধুর দুই কান লাল হৈয়া উঠিল---আমরা সকলেই তাহাতে বেশ খুশি হইলাম। পরে জানা গেল যে, এটি দাশুভায়ার কীর্তি, সে মজা দেখিবার জন্য উপক্রমণিকার জায়গায় ঠিক ঐরূপ মলাট দেওয়া একখানা বই রাখিয়া দিয়াছিল।
556 দাশুকে লইয়া আমরা সর্বদাই ঠাট্টা-তামাশা করিতাম এবং তাহার সামনেই তাহার বুদ্ধি ও চেহারা সম্বন্ধে অনেক অপ্রীতিকর আলোচনা করিতাম। তাহাতে বিরক্ত হওয়া দূরে থাকুক, বরং তাহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইত যেন সে বেশ আমোদ পাইতেছে। একেক সমযে সে নিজেই উত্সাহ করিয়া আমাদের মন্তব্যের উপর রঙ চড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত গল্প বলিত! একদিন সে বলিল, ``ভাই, আমাদের পাড়ায় যখনই কেউ আমসত্ত্ব বানায় তখনই আমার ডাক পড়ে। কেন জানিস?'' আমরা বলিলাম, ``খুব আমসত্ত্ব খাস বুঝি?'' সে বলিল, ``তা নয়। যখন আমসত্ত্ব শুকোতে দেয় আমি সেইখানে ছাদের ওপর বার দুয়েক এই চেহারাখানা দেখিয়ে আসি। তাতেই পাড়ার ত্রিসীমানার মধ্যে যত কাক সব `ত্রাহি ত্রাহি' করে ছুটে পালায়। কাজেই আর আমসত্ত্ব পাহারা দিতে হয় না।''
558 প্রত্যেকবার ছুটির পরে স্কুলে ফিরিবার সময় দাশু একটা-না-একটা কাণ্ড বাধাইয়া আসে। একবার সে হঠাত্ পেণ্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢলঢলে পায়জামার মতো পেণ্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং সেটা তাহার কাছে ভারি একটা আমোদের ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, ``পেণ্টেলুন পরেছিস কেন?'' দাশু একগাল হাসিয়া বলিল, ``ভালো করে ইংরাজি শিখব বলে।'' আরেকবার সে খামখা নেড়া মাথায় এক পট্টি বাঁধিয়া ক্লাশে আসিতে আরম্ভ করিল এবং আমরা সকলে তাহা লইয়া ঠাট্টা-তামাশা করায় যারপরনাই খুশি হইয়া উঠিল। দাশু আদপেই গান গাহিতে পারে না। তাহার যে তালজ্ঞান বা সুরজ্ঞান একেবারেই নেই, এ কথা সে বেশ জানে। তবু সেবার ইনস্পেক্টর সাহেব যখন স্কুল দেখিতে আসেন--- তখন আমাদের খুশি করিবার জন্য সে চীত্কার করিয়া গান শুনাইয়াছিল। আমরা কেহ ওরূপ করিলে সেদিন রীতিমতো শাস্তি পাইতাম। কিন্তু দাশু `পাগলা' বলিয়া কেহ তাহাকে কিছু বলিল না।
560 ছুটির পরে দাশু নূতন কি পাগলামি করে, তাহা দেখিবার জন্য আমরা ব্যস্ত হইয়া স্কুলে আসিতাম। কিন্তু যেবার সে অদ্ভুত এক বাক্স বগলে লইয়া ক্লাশে হাজির হইল, তখন আমরা বাস্তবিকই আশ্চর্য হইয়াছিলাম্। আমাদের মাস্টারমহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ``কি হে দাশু, ও বাক্সের মধ্যে কি এনেছ?'' দাশু বলিল, ``আজ্ঞে, আমার জিনিসপত্র।'' `জিনিসপত্র'টা কিরূপ হইতে পারে, এই লইয়া আমাদের মধ্যে বেশ একটু তর্ক হইয়া গেল। দাশুর সঙ্গে বই, খাতা, পেনসিল, ছুরি, সবই তো আছে, তবে আবার জিনিসপত্র কি রে বাপু? দাশুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সে সোজাসুজি কোনো উত্তর না দিয়া বাক্সটিকে আঁকড়াইয়া ধরিল এবং বলিল, ``খবরদার, আমার বাক্স তোমরা কেউ ঘেঁটো না।'' তাহার পর চাবি দিয়া বাক্সটাকে একটুখানি ফাঁক করিয়া, সে তাহার ভিতরে চাহিয়া কি যেন দেখিয়া লইল এবং `ঠিক আছে' বলিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বিড়্বিড়্ করিয়া হিসাব করিতে লাগিল। আমি একটুখানি দেখিবার জন্য উঁকি মারিতে গিয়াছিলাম---অমনি পাগলা মহা ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরাইয়া বাক্স বন্ধ করিয়া ফেলিল।
562 ক্রমে আমাদের মধ্যে তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইল। কেহ বলিল, ``ওটা ওর টিফিনের বাক্স--- ওর মধ্যে খাবার আছে।'' কিন্তু একদিনও টিফিনের সময় তাহাকে বাক্স খুলিয়া কিছু খাইতে দেখিলাম না। কেহ বলিল, ``ওটা বোধ হয় ওর মানিব্যাগ--- ওর মধ্যে টাকাপয়সা আছে, তাই ও সর্বদা কাছে কাছে রাখতে চায়।'' আরেকজন বলিল, ``টাকাপয়সার জন্য অত বড়ো বাক্স কেন? ও কি ইস্কুলে মহাজনী কারবার খুলবে নাকি?''
564 একদিন টিফিনের সময়ে দাশু হঠাত্ ব্যস্ত হইয়া বাক্সের চাবিটা আমার কাছে রাখিয়া গেল আর বলিল, ``এটা এখন তোমার কাছে রাখ, দেখো হারায় না যেন। আর আমার আসতে যদি একটু দেরি হয়, তবে--- তোমরা ক্লাশে যাবার আগে ওটা দরোয়ানের কাছে দিয়ে দিয়ো।'' এই কথা বলিয়া সে বাক্সটা দরোয়ানের জিম্মায় রাখিয়া বাহির হইয়া গেল। তখন আমাদের উত্সাহ দেখে কে! এতদিনে সুবিধা পাওয়া গিয়াছে, এখন হতভাগা দরোয়ানটা একটু তফাত্ গেলেই হয়। খানিকবাদে দরোয়ান তাহার রুটি পাকাইবার লোহার উনানটি ধরাইয়া কতকগুলা বাসনপত্র লইয়া কলতলার দিকে গেল। আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। দরোয়ান আড়াল হওয়া মাত্র আমরা পাঁচ-সাতজনে তাহার ঘরের কাছে সেই বাক্সের উপর ঝুঁকিয়া পড়িলাম। তার পর আমি চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া দেখি, বাক্সের মধ্যে বেশ ভারী একটা কাগজের পোঁটলা নেকড়ার ফালি দিয়া খুব করিয়া জড়ানো। তার পর তাড়াতাড়ি পোঁটলার প্যাঁচ খুলিয়া দেখ গেল, তাহার মধ্যে একখানা কাগজের বাক্স--- তার ভিতরে আরেকটি ছোট পোঁটলা। সেইটি খুলিয়া একখানা কার্ড বাহির হইল, তাহার একপিঠে লেখা `কাঁচকলা খাও' আরেকটি পিঠে লেখা `অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো নয়'। দেখিয়া আমরা এ-উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। সকলের শেষে একজন বলিয়া উঠিল, ``ছোকরা আচ্ছা যাহোক, আমাদের বেজায় ঠকিয়েছে।'' আরেকজন বলিল, ``যেমনভাবে বাঁধা ছিল, তেমনি করে রেখে দাও, সে যেন টের না পায় যে আমরা খুলেছিলাম। তা হলে সে নিজেই জব্দ হবে।'' আমি বলিলাম, ``বেশ কথা, ও ছোকরা আসলে পরে তোমরা খুব ভালোমানুষের মতো বাক্সটা দেখাতে বোলো আর ওর মধ্যে কি আছে--- সেটা বার করে জানতে চেয়ো।'' তখন আমরা তাড়াতাড়ি কাগজপত্রগুলি বাঁধিয়া, আগেকার মতো পোঁটলা পাকাইয়া বাক্সে ভরিয়া ফেলিলাম।
566 বাক্সে চাবি দিতে যাইতেছি, এমন সময় হো হো করিয়া একটা হাসির শব্দ শুনা গেল--- চাহিয়া দেখি পাঁচিলের উপর বসিয়া পাগলা দাশু হাসিয়া কুটিকুটি। হতভাগা এতক্ষণ চুপিচুপি তামাশা দেখিতেছিল। আর আমাদের কথাবার্তা সমস্ত শুনিতেছিল! তখন বুঝিলাম আমার কাছে চাবি দেওয়া, দরোয়ানের কাছে বাক্স রাখা, টিফিনের সময়ে বাইরে যাওয়ার ভান করা, এ-সমস্তই তাহার শয়তানি। আসল মতলবটি, আমাদের খানিকটা নাচাইয়া তামাশা দেখানো। খামখা আমাদের আহাম্মক বানাইবার জন্যই, সে মিছামিছি এ কয়দিন ধরিয়া ক্রমাগত একটা বাক্স, বহিয়া বেড়াইয়াছে।
568 সাধে কি বলি পাগলা দাশু?
571 নবীনচাঁদ স্কুলে এসেই বলল, কাল তাকে ডাকাতে ধরেছিল। শুনে স্কুলশুদ্ধ সবাই হাঁ হাঁ করে ছুটে আসল। ``ডাকাতে ধরেছিল? কি বলিস রে?" ডাকাত না তো কি? বিকেলবেলায় সে জ্যোতিলালের বাড়ি পড়তে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফিরবার সময়ে ডাকতেরা তাকে ধরে, তার মাথায় চাঁটি মেরে, তার নতুন কেনা শখের পিরানটিতে কাদাজলের পিচকিরি দিয়ে গেল। আর যাবার সময় বলে গেল, ``চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক্---নইলে দড়াম্ করে তোর মাথা উড়িয়ে দেব।'' তাই সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রাস্তার ধারে প্রায় বিশ মিনিট দাঁড়িয়েছিল; এমন সময় তার বড়মামা এসে তার কান ধরে বাড়িতে নিয়ে বললেন, ``রাস্তায় সং সেজে এয়ার্কি করা হচ্ছিল?'' নবীনচাঁদ কাঁদ-কাঁদ গলায় বলে উঠল ``আমি কি করব? আমায় ডাকাত ধরেছিল---'' শুনে তার মামা প্রকাণ্ড এক চড় তুলে বললেন, ``ফের জ্যাঠামি!'' নবীনচাঁদ দেখল মামার সঙ্গে তর্ক করাই বৃথা--- কারণ, সত্যিসত্যিই তাকে যে ডাকাতে ধরেছিল, এ কথা তার বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করানো শক্ত! সুতরাং তার মনের দুঃখ এতক্ষণ মনের মধ্যেই চাপা ছিল। স্কুলে এসে আমাদের কাছে বসতে না বসতেই সে দুঃখ একেবারে উথলিয়ে উঠল।
573 যাহোক, স্কুলে এসে তার দুঃখ বোধ হয় অনেকটা দুর হতে পেরেছিল, কারণ, স্কুলের অন্তত অর্ধেক ছেলে তার কথা শুনবার জন্য একেবারে ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়েছিল, এবং তার ঘামাচি, ফুসকুড়ি আর চুলকানির দাগটি পর্যন্ত তারা আগ্রহ করে ডাকাতির সুস্পষ্ট প্রমান বলে স্বীকার করেছিল। দুয়েকজন, যারা তার কনুয়ের আঁচড়টাকে পুরনো বলে সন্দেহ করেছিল, তারাও বলল যে হাঁটুর কাছে যে ছড়ে গেছে সেটা একেবারে টাটকা নতুন। কিন্তু তার পায়ের গোড়ালিতে যে ঘায়ের মত ছিল সেটাকে দেখে কেষ্টা যখন বলল, ``ওটা তো জুতোর ফোস্কা,'' তখন নবীনচাঁদ ভয়ানক চটে বলল, ``যাও, তোমাদের কাছে আর কিচ্ছু বলব না!'' কেষ্টাটার জন্য আমাদের আর কিছুই শোনা হল না।
575 ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে, ঢং ঢং করে স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেল। সবাই যে যার ক্লাশে চলে গেলাম, এমন সময় দেখি পাগলা দাশু একগাল হাসি নিয়ে ক্লাশে ঢুকছে। আমরা বললাম, ``শুনেছিস? কাল নবুকে ডাকাতে ধরেছিল।'' যেমন বলা, অমনি দাশরথি হঠাত্ হাত-পা ছেড়ে বইটই ফেলে খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ করে হাসতে হাসতে একেবারে মেঝের ওপর বসে পড়ল! পেটে হাত দিয়ে গড়াগড়ি করে, একবার চিত হয়ে, একবার উপুড় হয়ে, তার হাসি আর কিছুতেই থামে না! দেখে আমরা তো অবাক! পণ্ডিতমশায় ক্লাসে এসেছেন, তখনো পুরোদমে তার হাসি চলেছে। সবাই ভাবল, ``ছোঁড়াটা খেপে গেল নাকি?'' যা হোক, খুব খানিকটা হুটোপুটির পর সে ঠান্ডা হয়ে, বইটই গুটিয়ে বেঞ্চের উপর উঠে বসল। পণ্ডিতমশায় বললেন, ``ওরকম হাসছিলে কেন?'' দাশু নবিনচাঁদকে দেখিয়ে বলল, ``ঐ ওকে দেখে।'' পণ্ডিতমশায় খুব কড়ারকমের ধমক লাগিয়ে তাকে ক্লাসের কোনায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। কিন্তু পাগলার তাতেও লজ্জা নেই, সে সারাটি ঘন্টা থেকে থেকে বই দিয়ে মুখ আড়াল করে ফিক্ফিক্ করে হাসতে লাগল।
577 টিফিনের ছুটির সময়ে নবু দাশুকে চেপে ধরল, ``কিরে দেশো! বড়ো যে হাসতে শিখেছিস!'' দাশু বলল, ``হাসব না? তুমি কাল ধুচুনি মাথায় দিয়ে কি রকম নাচটা নেচেছিলে, সে তো আর তুমি নিজে দেখনি? দেখলে বুঝতে কেমন মজা!'' আমরা সবাই বললাম, ``সে কি রকম? ধুচুনি মাথায় নচছিল মানে?'' দাশু বলল ``তাও জান না? ঐ কেষ্টা আর জগাই--- ঐ যা! বলতে বারণ করেছিল!'' আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ``কি বলছিস ভালো করেই বল-না।'' দাশু বলল, ``কালকে শেঠেদের বাগানের পেছন দিয়ে নবু একলা একলা বাড়ি যাচ্ছিল, এমন সময়ে দুটো ছেলে--- তাদের নাম বলতে বারণ--- তারা দৌড়ে এসে নবুর মাথায় ধুচুনির মতো কি একটা চাপিয়ে তার গায়ের উপর আচ্ছা করে পিচকিরি দিয়ে পালিয়ে গেল!'' নবু ভয়ানক দেগে বলল, ``তুই তখন কি করছিলি?'' দাশু বলল, ``তুমি তখন মাথার থলি খুলবার জন্য ব্যাঙের মতো হাত-পা ছুড়ে লাফাচ্ছিলে দেখে আমি বললাম, ফের নড়বি তো দড়াম্ করে মাথা উড়িয়ে দেব। তাই শুনে তুমি রাস্তার মধ্যে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে, তাই আমি তোমার বড়োমামাকে ডেকে আনলাম।'' নবীনচাঁদের যেমন বাবুয়ানা, তেমনি তার দেমাক--- সেইজন্য কেউ তাকে পছন্দ করত না, তার লাঞ্ছনার বর্ণণা শুনে সবাই বেশ খুশি হলাম। ব্রজলাল ছেলেমানুষ, সে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বলব, ``তবে যে নবীনদা বলছিল তাকে ডাকাতে ধরেছে?'' দাশু বলল, ``দূর বোকা! কেষ্টা কি ডাকাত?'' বলতে না বলতেই কেষ্টা সেখানে এসে হাজির। কেষ্টা আমাদের উপরের ক্লাসে পড়ে, তার গায়েও বেশ জোর আছে। নবীনচাঁদ তাকে দেখবামাত্র শিকারি বেড়ালের মতো ফুলে উঠল। কিন্তু মারামারি করতে সাহস পেল না, খানিকক্ষণ কট্মট্ করে তাকিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল। আমরা ভাবলাম গোলমাল মিটে গেল!
579 কিন্তু তার পরদিন ছুটির সময় দেখি, নবীন তার দাদা মোহনচাঁদকে নিয়ে হন্হন্ করে আমাদের দিকে আসছে। মোহনচাঁদ এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়ে, সে আমাদের চাইতে অনেক বড়ো, তাকে ওরকমভাবে আসতে দেখেই আমরা বুঝলাম এবার একটা কাণ্ড হবে। মোহন এসেই বলল, ``কেষ্টা কই?'' কেষ্টা দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়েই কোথায় সরে পড়েছে, তাই তাকে আর পাওয়া গেল না। তখন নবীনচাঁদ বলল ``ওই দাশুটা সব জানে, ওকে জিঞ্জেসা কর।'' মোহন বলল, ``কি হে ছোকরা তুমি সব জান নাকি?'' দাশু বলল, ``না, সব আর জানব কোত্থেকে--- এই তো সবে ফোর্থ ক্লাসে পড়ি, একটু ইংরিজি জানি, ভুগোল, বাংলা, জিওমেট্রি---'' মোহনচাঁদ ধমক দিয়ে বলল, ``সেদিন নবুকে যে কারা সব ঠেঙিয়েছিল, তুমি তার কিছু জান কি না?'' দাশু বলল, ঠ্যাঙায় নি তো--- মেরেছিল, খুব আস্তে মেরেছিল।'' মোহন একটুখানি ভেংচিয়ে বলল, ``খুব আস্তে মেরেছে, না? কতখানি আস্তে শুনি তো?'' দাশু বলল, ``সে কিছুই না--- ওরকম মারলে একটুও লাগে না।'' মোহন আবার ব্যঙ্গ করে বলল, ``তাই নাকি? কি রকম মারলে পরে লাগে?'' দাশু খানিকটা মাথা চুলকিয়ে তার পর বললে, ``ঐ সেবার হেডমাস্টার মশাই তোমায় যেমন বেত মেরেছিলেন সেইরকম!'' এই কথায় মোহন ভয়ানক চটে দাশুর কান মলে দিয়ে চীত্কার করে বলল, ``দ্যাখ বেয়াদব। ফের জ্যাঠামি করবি তো চাবকিয়ে লাল করে দেব। তুই সেখানে ছিলি কি না। আর কি রকম কি মেরেছিল সব খুলে বলবি কি না?''
581 জানই তো দাশুর মেজাজ কেমন পাগলাটেগোছের, সে একটুখানি কানে হাত বুলিয়ে তার পর মোহনচাঁদকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে বসল। কিল, ঘুঁষি, চড়, আঁচড়, কামড়, সে এমনি চটপট চালিয়ে গেল জে আমরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। মোহন বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবে নি যে ফোর্থ ক্লাশের একটা রোগাছেলে তাকে অমনভাবে তেড়ে আসতে সাহস পাবে--- তাই সে একেবারে থতমত খেয়ে কেমন যেন লড়তেই পারল না। দাশু তাকে পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে মাটিতে চিতপাত্ করে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ``এর চাইতেও ঢের আস্তে মেরেছিল।'' এনট্রান্স ক্লাশের কয়েকটি ছেলে সেখানে দাড়িয়েছিল। তারা যদি মোহনকে সামলে না ফেলত, তা হলে সেদিন তার হাত থেকে দাশুকে বাঁচানোই মুস্কিল হত।
583 পরে একদিন কেষ্টাকে জিঞ্জেস করা হয়েছিল, ``হাঁ রে, নবুকে সেদিন তোরা অমন করলি কেন?'' কেষ্টা বলল, ``ঐ দাশুটাই তো শিখিয়েছিল ওরকম করতে। আর বলেছিল, `তা হলে এক সের জিলিপি পাবি'!'' আমরা বললাম, ``কই, আমাদের তো ভাগ দিলি নে?'' কেষ্টা বলল, ``সে কথা আর বলিস কেন? জিলিপি চাইতে গেলুম, হতভাগা বলে কিনা `আমার কাছে কেন? ময়রার দোকানে যা, পয়সা ফেলে দে, যত চাস জিলিপি পাবি'।''
585 আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না, কেবল মিচ্কেমি করে?
586 সন্দেশ--- চৈত্র, ১৩২৪
589 কথা ও কাহিনী --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
592 শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
593 বাবু বলিলেন, ``বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।''
594 কহিলাম আমি, ``তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।
595 চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।''
596 শুনি রাজা কহে, ``বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
597 পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দীঘে সমান হইবে টানা---
598 ওটা দিতে হবে।'' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
599 সজলচক্ষে, ``করুণ রক্ষে গরিবের ভিটেখানি!
600 সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া!
601 দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!''
602 আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে;
603 কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে, ``আচ্ছা, সে দেখা যাবে।''
605 পরে মাস-দেড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে---
606 করিল ডিক্রি সকলি বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
607 এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি!
608 রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
609 মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
610 তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
611 সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য---
612 কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য!
613 ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি,
614 তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
615 হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
616 একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।
618 নমোনমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি---
619 গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
620 অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি---
621 ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
622 পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ---
623 স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল, নিশীথশীতল স্নেহ।
624 বুকভরা মধু, বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে---
625 ``মা'' বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
626 দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে,
627 কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে---
628 রাখি হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
629 তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।
631 ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি,
632 যখনি যাহার তখনি তাহার--- এই কি জননী তুমি!
633 সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
634 আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
635 আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ---
636 পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
637 আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
638 তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
639 ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন---
640 কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন!
641 কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
642 যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী--- হলে দাসী।
644 বিদীর্ণ-হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি;
645 প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ, একি!
646 বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
647 একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক-কালের কথা।
648 সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিক ঘুম---
649 অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম;
650 সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন---
651 ভাবিলাম, হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!
652 সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে;
653 দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
654 ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা---
655 স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা!
657 হেনকালে হায় যমদূত-প্রায় কোথা হতে এল মালী,
658 ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি!
659 কহিলাম তবে, ``আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব---
660 দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব!''
661 চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
662 বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ।
663 শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ``মারিয়া করিব খুন!''
664 বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
665 আমি কহিলাম, ``শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!''
666 বাবু কহে হেসে, ``বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।''
667 আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে!
668 তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
673 কথা ও কাহিনী --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
676 গাহিছে কাশীনাথ নবীন যুবা, ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি,
677 কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর সাতটি যেন পোষা পাখি;
678 শানিত তরবারি গলাটি যেন নাচিয়া ফিরে দশ দিকে---
679 কখন কোথা যায় না পাই দিশা, বিজুলি-হেন ঝিকিমিকে।
680 আপনি গড়ি তোলে বিপদজাল, আপনি কাটি দেয় তাহা;
681 সভার লোকে শুনে অবাক মানে, সঘনে বলে `বাহা বাহা'।
683 কেবল বুড়া রাজা প্রতাপরায় কাঠের মতো বসি আছে;
684 বরজলাল ছাড়া কাহারো গান ভালো না লাগে তার কাছে।
685 বালক-বেলা হতে তাহারি গীতে দিল সে এতকাল যাপি---
686 বাদল-দিনে কত মেঘের গান, হোলির দিনে কত কাফি।
687 গেয়েছে আগমনী শরত্প্রাতে, গেয়েছে বিজয়ার গান---
688 হৃদয় উছসিয়া অশ্রুজলে ভাসিয়া গিয়াছে দুনয়ান।
689 যখনি মিলিয়াছে বন্ধুজনে সভার গৃহ গেছে পূরে,
690 গেয়েছে গোকুলের গোয়াল-গাথা ভূপালি মূলতানি সুরে।
691 ঘরেতে বারবার এসেছে কত বিবাহ-উত্সব-রাতি---
692 পরেছে দাসদাসী লোহিত বাস, জ্বলেছে শত শত বাতি,
693 বসেছে নব বর সলাজ মুখে পরিয়া মণি-আভরণ,
694 করিছে পরিহাস কানের কাছে সমবয়সী প্রিয়জন,
695 সামনে বসি তার বরজলাল ধরেছে সাহানার সুর---
696 সে-সব দিন আর সে-সব গান হৃদয়ে আছে পরিপূর।
697 সে ছাড়া কারো গান শুনিলেই তাই মর্মে গিয়ে নাহি লাগে
698 অতীত প্রাণ যেন মন্ত্রবলে নিমেষে প্রাণে নাহি জাগে।
699 প্রতাপরায় তাই দেখিছে শুধু কাশীর বৃথা মাথা-নাড়া---
700 সুরের পরে সুর ফিরিয়া যায়, হৃদয়ে নাহি পায় সাড়া।
702 থামিল গান যবে ক্ষণেক-তরে বিরাম মাগে কাশীনাথ;
703 বরজলাল-পানে প্রতাপ রায় হাসিয়া করে আঁখিপাত।
704 কানের কাছে তার রাখিয়া মুখ কহিল, ``ওস্তাদজি,
705 গানের মতো গান শুনায়ে দাও, এরে কি গান বলে, ছি!
706 এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে, শিকারী বিড়ালের খেলা।
707 সেকালে গান ছিল, একালে হায় গানের বড়ো অবহেলা।''
709 বরজলাল বুড়া শুক্লকেশ, শুভ্র উষ্ণীষ শিরে,
710 বিনতি করি সবে সভার মাঝে আসন নিল ধীরে ধীরে।
711 শিরা-বাহির-করা শীর্ণ করে তুলিয়া নিল তানপুর,
712 ধরিল নতশিরে নয়ন মুদি ইমনকল্যাণ সুর।
713 কাঁপিয়া ক্ষীণ স্বর মরিয়া যায় বৃহত্ সভাগৃহকোণে,
714 ক্ষুদ্র পাখি যথা ঝড়ের মাঝে উড়িতে নারে প্রাণপণে।
715 বসিয়া বাম পাশে প্রতাপরায়, দিতেছে শত উত্সাহ---
716 ``আহাহা, বাহা বাহা'' কহিছে কানে, ``গলা ছাড়িয়া গান গাহ।''
718 সভার লোকে সবে অন্যমনা, কেহ বা কানাকানি করে।
719 কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে, কেহ বা চ'লে যায় ঘরে।
720 ``ওরে রে আয় লয়ে তামাকু পান'' ভৃত্যে ডাকি কেহ কয়।
721 সঘনে পাখা নাড়ি কেহ বা বলে, ``গরম আজি অতিশয়।''
722 করিছে আনাগোনা ব্যস্ত লোক, ক্ষণেক নাহি রহে চুপ।
723 নীরব ছিল সভা, ক্রমশ সেথা শব্দ ওঠে শতরূপ।
725 বুড়ার গান তাহে ডুবিয়া যায়, তুফান-মাঝে ক্ষীণ তরী---
726 কেবল দেখা যায় তানপুরায় আঙুল কাঁপে থরথরি।
727 হৃদয়ে যেথা হতে গানের সুর উছসি উঠে নিজসুখে
728 হেলার কলরব শিলার মতো চাপে সে উত্সের মুখে---
729 কোথায় গান আর কোথায় প্রাণ দু দিকে ধায় দুই জনে,
730 তবুও রাখিবারে প্রভুর মান বরজ গায় প্রাণপণে।
732 গানের এক পদ মনের ভ্রমে হারায়ে গেল কী করিয়া,
733 আবার তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গাহে--- লইতে চাহে শুধরিয়া।
734 আবার ভুলে যায় পড়ে না মনে, শরমে মস্তক নাড়ি
735 আবার শুরু হতে ধরিল গান--- আবার ভুলি দিল ছাড়ি।
736 দ্বিগুণ থরথরি কাঁপিছে হাত, স্মরণ করে গুরুদেবে।
737 কণ্ঠ কাঁপিতেছে কাতরে, যেন বাতাসে দীপ নেবে-নেবে।
738 গানের পদ তবে ছাড়িয়া দিয়া রাখিল সুরটুকু ধরি,
739 সহসা হাহারবে উঠিল কাঁদি গাহিতে গিয়া হা-হা করি।
740 কোথায় দূরে গেল সুরের খেলা, কোথায় তাল গেল ভাসি,
741 গানের সুতা ছিঁড়ি পড়িল খসি, অশ্রু-মুকুতার রাশি।
742 কোলের সখী তানপুরার 'পরে রাখিল লজ্জিত মাথা---
743 ভুলিল শেখা গান, পড়িল মনে বাল্যক্রন্দনগাথা।
744 নয়ন ছলছল, প্রতাপরায় কর বুলায় তার দেহে---
745 ``আইস হেথা হতে আমরা যাই'' কহিল সকরুণ স্নেহে।
746 শতেক-দীপ-জ্বালা নয়ন-ভরা ছাড়ি সে উত্সবঘর
747 বাহিরে গেল দুটি প্রাচীন সখা ধরিয়া দুঁহু দোঁহা-কর।
749 বরজ করজোড়ে কহিল, ``প্রভু, মোদের সভা হল ভঙ্গ।
750 এখন আসিয়াছে নূতন লোক, ধরায় নব নব রঙ্গ!
751 জগতে আমাদের বিজন সভা কেবল তুমি আর আমি---
752 সেথায় আনিয়ো না নূতন শ্রোতা, মিনতি তব পদে স্বামী!
753 একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুই জনে---
754 গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেক জন গাবে মনে।
755 তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ তবে সে কলতান উঠে---
756 বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে, তবে সে মর্মর ফুটে।
757 জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি যুগল মিলিয়াছে আগে---
758 যেখানে প্রেম নাই, বোবার সভা, সেখানে গান নাহি জাগে।''
764 কথা ও কাহিনী --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
767 ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর---
768 যা-কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ``কেষ্টা বেটাই চোর।''
769 উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে।
770 যত পায় বেত না পায় বেতন, তবু না চেতন মানে।
771 বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ চীত্কার করি ``কেষ্টা''---
772 যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।
773 তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে;
774 একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা করে আনে।
775 যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে নিদ্রাটি আছে সাধা;
776 মহাকলরবে গালি দেই যবে ``পাজি হতভাগা গাধা''---
777 দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে, দেখে জ্বলে যায় পিত্ত।
778 তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার--- বড়ো পুরাতন ভৃত্য।
780 ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি বলে, ``আর পারি নাকো,
781 রহিল তোমার এ ঘর-দুয়ার, কেষ্টারে লয়ে থাকো।
782 না মানে শাসন বসন বাসন অশন আসন যত
783 কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো যেতেছে জলের মতো।
784 গেলে সে বাজার সারা দিনে আর দেখা পাওয়া তার ভার---
785 করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর!''
786 শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে, আনি তার টিকি ধরে;
787 বলি তারে, ``পাজি, বেরো তুই আজই, দূর করে দিনু তোরে।''
788 ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়; পরদিনে উঠে দেখি,
789 হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি---
790 প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ, অতি অকাতর চিত্ত!
791 ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে--- মোর পুরাতন ভৃত্য!
793 সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি।
794 করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি।
795 পরিবার তায় সাথে যেতে চায়, বুঝায়ে বলিনু তারে---
796 পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, নহিলে খরচ বাড়ে।
797 লয়ে রশারশি করি কষাকষি পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি
798 বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি,
799 ``পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে কষ্ট অনেক পাবে।''
800 আমি কহিলাম, ``আরে রাম রাম! নিবারণ সাথে যাবে।''
801 রেলগাড়ি ধায়; হেরিলাম হায় নামিয়া বর্ধমানে---
802 কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত, তামাক সাজিয়া আনে!
803 স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর কত বা সহিব নিত্য!
804 যত তারে দুষি তবু হনু খুশি হেরি পুরাতন ভৃত্য!
806 নামিনু শ্রীধামে--- দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত
807 লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত।
808 জন-ছয়-সাতে মিলি এক-সাথে পরমবন্ধুভাবে
809 করিলাম বাসা; মনে হল আশা, আরামে দিবস যাবে।
810 কোথা ব্রজবালা কোথা বনমালা, কোথা বনমালী হরি!
811 কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি।
812 বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ;
813 আমি একা ঘরে ব্যাধি-খরশরে ভরিল সকল অঙ্গ।
814 ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ, ``কেষ্ট আয় রে কাছে।
815 এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।''
816 হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক, সে যেন পরম বিত্ত---
817 নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে মোর পুরতন ভৃত্য।
819 মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল, শিরে দেয় মোর হাত;
820 দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম, মুখে নাই তার ভাত।
821 বলে বার বার, ``কর্তা, তোমার কোনো ভয় নাই, শুন---
822 যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন।''
823 লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম; তাহারে ধরিল জ্বরে;
824 নিল সে আমার কালব্যাধিভার আপনার দেহ-'পরে।
825 হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন, বন্ধ হইল নাড়ী;
826 এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে, এতদিনে গেল ছাড়ি।
827 বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরিনু সারিয়া তীর্থ;
828 আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই মোর পুরাতন ভৃত্য।
833 কথা ও কাহিনী --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
836 গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে
837 মৈত্রমহাশয় যাবেন সাগরসঙ্গমে
838 তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি
839 কত বালবৃদ্ধ নরনারী; নৌকা দুটি
843 মোক্ষদা কহিল আসি, ``হে দাদাঠাকুর,
844 আমি তব হব সাথি।'' বিধবা যুবতী---
845 দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি,
846 কেবল মিনতি করে--- অনুরোধ তার
847 এড়ানো কঠিন বড়ো। ``স্থান কোথা আর''
848 মৈত্র কহিলেন তারে। ``পায়ে ধরি তব''
849 বিধবা কহিল কাঁদি, ``স্থান করি লব
850 কোনোমতে এক ধারে।'' ভিজে গেল মন,
851 তবু দ্বিধাভরে তারে শুধালো ব্রাহ্মণ,
852 ``নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?''
853 উত্তর করিল নারী, ``রাখাল? সে রবে
854 আপন মাসির কাছে। তার জন্মপরে
855 বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে,
856 বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন
857 আপন শিশুর সাথে দিয়ে তারে স্তন
858 মানুষ করেছে যত্নে--- সেই হতে ছেলে
859 মাসির আদরে আছে মার কোল ফেলে।
860 দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন
861 মাসি আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন
862 কোলে তারে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে
863 মার চেয়ে আপনার মাসিমার বুকে।''
865 সম্মত হইল বিপ্র। মোক্ষদা সত্বর
866 প্রস্তুত হইল বাঁধি জিনিস-পত্তর,
867 প্রণমিয়া গুরুজনে, সখীদলবলে
868 ভাসাইয়া বিদায়ের শোক-অশ্রুজলে।
869 ঘাটে আসি দেখে--- সেথা আগে-ভাগে ছুটি
870 রাখাল বসিয়া আছে তরী-'পরে উঠি
871 নিশ্চিন্ত নীরবে। ``তুই হেথা কেন ওরে''
872 মা শুধালো; সে কহিল, ``যাইব সাগরে।''
873 ``যাইবি সাগরে! আরে, ওরে দস্যু ছেলে,
874 নেমে আয়।'' পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে
875 সে কহিল দুটি কথা, ``যাইব সাগরে।''
876 যত তার বাহু ধরি টানাটানি করে
877 রহিল সে তরণী আঁকড়ি। অবশেষে
878 ব্রাহ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে,
879 ``থাক্ থাক্, সঙ্গে যাক।'' মা রাগিয়া বলে,
880 ``চল্, তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে।''
881 যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে
882 অমনি মায়ের বক্ষ অনুতাপবাণে
883 বিঁধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন
884 ``নারায়ণ নারায়ণ'' করিল স্মরণ---
885 পুত্রে নিল কোলে তুলি, তার সর্বদেহে
886 করুণ কল্যাণহস্ত বুলাইল স্নেহে।
887 মৈত্র তারে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়,
888 ``ছি ছি ছি, এমন কথা বলিবার নয়।''
890 রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা---
891 অন্নদা লোকের মুখে শুনি সে বারতা
892 ছুটে আসি বলে, ``বাছা, কোথা যাবি ওরে!''
893 রাখাল কহিল হাসি, ``চলিনু সাগরে,
894 আবার ফিরিব মাসি!'' পাগলের প্রায়
895 অন্নদা কহিল ডাকি, ``ঠাকুরমশায়,
896 বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,
897 কে তাহারে সামালিবে! জন্ম হতে তার
898 মাসি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও;
899 কোথা এরে নিয়ে যাবে, ফিরে দিয়ে যাও।''
900 রাখাল কহিল, ``মাসি, যাইব সাগরে,
901 আবার ফিরিব আমি।'' বিপ্র স্নেহভরে
902 কহিলেন, ``যতক্ষণ আমি আছি ভাই,
903 তোমার রাখাল লাগি কোনো ভয় নাই।
904 এখন শীতের দিন শান্ত নদীনদ,
905 অনেক যাত্রীর মেলা, পথের বিপদ
906 কিছু নাই; যাতায়াত মাস-দুই কাল,
907 তোমারে ফিরায়ে দিব তোমার রাখাল।''
909 শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি,
910 দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী
911 অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাতশিশিরে
912 ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে।
914 যাত্রীদল ফিরে আসে, সাঙ্গ হল মেলা।
915 তরণী তীরেতে বাঁধা অপরাহ্ণবেলা
916 জোয়ারের আশে। কৌতূহল-অবসান,
917 কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ
918 মাসির কোলের লাগি। জল শুধু জল,
919 দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।
920 মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর,
921 লোলুপ লেলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রূর
922 খল জল ছল-ভরা, তুলি লক্ষ ফণা
923 ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা
924 মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ।
925 হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমূক,
926 অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন,
927 সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন
928 শ্যামলকোমলা, যেথা যে-কেহই থাকে
929 অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে
930 অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কী বিপুল টানে
931 দিগন্তবিস্তৃত তব শান্ত বক্ষ-পানে!
933 চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
934 অধীর উত্সুক কণ্ঠে শুধায় ব্রাহ্মণে,
935 ``ঠাকুর, কখন আজি আসিবে জোয়ার?''
937 সহসা স্তিমিত জলে আবেগসঞ্চার
938 দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে।
939 ফিরিল তরীর মুখ, মৃদু আর্তনাদে
940 কাছিতে পড়িল টান, কলশব্দগীতে
941 সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে---
942 আসিল জোয়ার। মাঝি দেবতারে স্মরি
943 ত্বরিত উত্তর-মুখে খুলে দিল তরী।
944 রাখাল শুধায় আসি ব্রাহ্মণের কাছে,
945 ``দেশে পঁহুছিতে আর কত দিন আছে?''
947 সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে
948 উত্তর-বায়ুর বেগ ক্রমে ওঠে বেড়ে!
949 রূপনারানের মুখে পড়ি বালুচর
950 সংকীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর
951 জোয়ারের স্রোতে আর উত্তরসমীরে
952 উত্তাল উদ্দাম। ``তরণী ভিড়াও তীরে''
953 উচ্চকণ্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল।
954 কোথা তীর! চারি দিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল
955 আপনার রুদ্র নৃত্যে দেয় করতালি
956 লক্ষ লক্ষ হাতে, আকাশেরে দেয় গালি
957 ফেনিল আক্রোশে। এক দিকে যায় দেখা
958 অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা,
959 অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারিরাশি
960 প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি
961 উদ্ধতবিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল,
962 ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল
963 মূঢ়সম। তীব্রশীতপবনের সনে
964 মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে
965 কাঁপাইছে থরহরি। কেহ হতবাক্,
966 কেহ বা ক্রন্দন করে ছাড়ে ঊর্ধ্বডাক
967 ডাকি আত্মজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে
968 চক্ষু মুদি করে জপ। জননীর বুকে
969 রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে।
970 তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে,
971 ``বাবারে দিয়েছে ফাঁকি তোমাদের কেউ,
972 যা মেনেছে দেয় নাই, তাই এত ঢেউ---
973 অসময়ে এ তুফান। শুন এই বেলা---
974 করহ মানত রক্ষা, করিয়ো না খেলা
975 ক্রুদ্ধ দেবতার সনে।'' যার যত ছিল
976 অর্থ বস্ত্র যাহা-কিছু জলে ফেলি দিল
977 না করি বিচার। তবু, তখনি পলকে
978 তরীতে উঠিল জল দারুণ ঝলকে।
979 মাঝি কহে পুনর্বার, ``দেবতার ধন
980 কে যায় ফিরায়ে লয়ে এই বেলা শোন্।''
981 ব্রাহ্মণ সহসা উঠি কহিলা তখনি
982 মোক্ষদারে লক্ষ্য করি, ``এই সে রমণী
983 দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে
984 চুরি করে নিয়ে যায়।'' ``দাও তারে ফেলে''
985 এক বাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর
986 যাত্রী সবে। কহে নারী, ``হে দাদাঠাকুর,
987 রক্ষা করো, রক্ষা করো!'' দুই দৃঢ় করে
988 রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে।
989 ভর্ত্সিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ,
990 ``আমি তোর রক্ষাকর্তা! রোষে নিশ্চেতন
991 মা হয়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে---
992 শেষকালে আমি রক্ষা করিব তাহারে!
993 শোধ্ দেবতার ঋণ; সত্য ভঙ্গ ক'রে
994 এতগুলি প্রাণী তুই ডুবাবি সাগরে!''
995 মোক্ষদা কহিল, ``অতি মূর্খ নারী আমি,
996 কী বলেছি রোষবশে--- ওগো অন্তর্যামী,
997 সেই সত্য হল! সে যে মিথ্যা কত দূর
998 তখনি শুনে কি তুমি বোঝ নি ঠাকুর?
999 শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা,
1000 শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা?''
1002 বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি-দাঁড়ি
1003 বল করি রাখালেরে নিল ছিঁড়ি কাড়ি
1004 মার বক্ষ হতে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি
1005 ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি
1006 দন্তে দন্তে চাপি বলে। কে তাঁরে সহসা
1007 মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা---
1008 দংশিল বৃশ্চিকদংশ। ``মাসি! মাসি! মাসি!''
1009 বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি
1010 নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক।
1011 চীত্কারি উঠিল বিপ্র, ``রাখ্ রাখ্ রাখ্।''
1012 চকিতে হেরিল চাহি মূর্ছি আছে পড়ে
1013 মোক্ষদা চরণে তাঁর, মুহূর্তের তরে
1014 ফুটন্ত তরঙ্গ-মাঝে মেলি আর্ত চোখ
1015 ``মাসি'' বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক
1016 অনন্ততিমিরতলে; শুধু ক্ষীণ মুঠি
1017 বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি
1018 আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।
1019 ``ফিরায়ে আনিব তোরে'' কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে
1020 ব্রাহ্মণ মুহূর্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে---
1021 আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।
1026 কথা ও কাহিনী --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
1029 নিম্নে আবর্তিয়া ছুটে যমুনার জল---
1030 দুই তীরে গিরিতট, উচ্চ শিলাতল!
1031 সংকীর্ণ গুহার পথে মূর্ছি জলধার
1032 উন্মত্ত প্রলাপে ওঠে গর্জি অনিবার।
1034 এলায়ে জটিল বক্র নির্ঝরের বেণী
1035 নীলাভ দিগন্তে ধায় নীল গিরিশ্রেণী।
1036 স্থির তাহা, নিশিদিন তবু যেন চলে---
1037 চলা যেন বাঁধা আছে অচল শিকলে।
1039 মাঝে মাঝে শাল তাল রয়েছে দাঁড়ায়ে,
1040 মেঘেরে ডাকিছে গিরি ইঙ্গিত বাড়ায়ে।
1041 তৃণহীন সুকঠিন শতদীর্ণ ধরা,
1042 রৌদ্রবর্ণ বনফুলে কাঁটাগাছ ভরা।
1044 দিবসের তাপ ভূমি দিতেছে ফিরায়ে,
1045 দাঁড়ায়ে রয়েছে গিরি আপনার ছায়ে---
1046 পথশূন্য, জনশূন্য, সাড়া-শব্দ-হীন।
1047 ডুবে রবি, যেমন সে ডুবে প্রতিদিন।
1049 রঘুনাথ হেথা আসি যবে উত্তরিলা
1050 শিখগুরু পড়িছেন ভগবত্-লীলা।
1051 রঘু কহিলেন নমি চরণে তাঁহার,
1052 ``দীন আনিয়াছে, প্রভু, হীন উপহার।''
1054 বাহু বাড়াইয়া গুরু শুধায়ে কুশল
1055 আশিসিলা মাথায় পরশি করতল।
1056 কনকে মাণিক্যে গাঁথা বলয় দুখানি
1057 গুরুপদে দিলা রঘু জুড়ি দুই পাণি।
1059 ভূমিতল হইতে বালা লইলেন তুলে,
1060 দেখিতে লাগিলা প্রভু ঘুরায়ে অঙ্গুলে।
1061 হীরকের সূচীমুখ শতবার ঘুরি
1062 হানিতে লাগিল শত আলোকের ছুরি।
1064 ঈষত্ হাসিয়া গুরু পাশে দিলা রাখি,
1065 আবার সে পুঁথি-'পরে নিবেশিলা আঁখি।
1066 সহসা একটি বালা শিলাতল হতে
1067 গড়ায়ে পড়িয়া গেল যমুনার স্রোতে।
1069 ``আহা আহা'` চীত্কার করি রঘুনাথ
1070 ঝাঁপায়ে পড়িল জলে বাড়ায়ে দু হাত।
1071 আগ্রহে সমস্ত তার প্রাণমন কায়
1072 একখানি বাহু হয়ে ধরিবারে যায়।
1074 বারেকের তরে গুরু না তুলিলা মুখ,
1075 নিভৃত অন্তরে তাঁর জাগে পাঠসুখ।
1076 কালো জল কটাক্ষিয়া চলে ঘুরি ঘুরি,
1077 যেন সে ছলনা-ভরা সুগভীর চুরি।
1079 দিবালোক চলে গেল দিবসের পিছু,
1080 যমুনা উতলা করি না মিলিল কিছু।
1081 সিক্তবস্ত্রে রিক্তহাতে, শ্রান্ত নতশিরে
1082 রঘুনাথ গুরু-কাছে আসিলেন ফিরে।
1084 ``এখনো উঠাতে পারি'' করজোড়ে যাচে,
1085 ``যদি দেখাইয়া দাও কোনখানে আছে।''
1086 দ্বিতীয় কঙ্কণখানি ছুঁড়ি দিয়া জলে
1087 গুরু কহিলেন, ``আছে ঐ নদীতলে।''
1092 কথা ও কাহিনী --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
1095 দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর পর
1096 বয়স না হতে হতে পুরা দু বছর।
1097 এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন
1098 স্বামীরেও হারালো মল্লিকা। বন্ধুজন
1099 বুঝাইল--- পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ,
1100 এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ।
1101 শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে
1102 অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে
1103 প্রায়শ্চিত্তে দিল মন। মন্দিরে মন্দিরে
1104 যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়া ফিরে।
1105 ব্রতধ্যান-উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে
1106 কাটে দিন ধূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে,
1107 পূজাগৃহে; কেশে বাঁধি রাখিল মাদুলি
1108 কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি;
1109 শুনে রামায়ণকথা; সন্ন্যাসী-সাধুরে
1110 ঘরে আনি আশীর্বাদ করায় শিশুরে।
1111 বিশ্বমাঝে আপনারে রাখি সর্ব-নীচে
1112 সবার প্রসন্ন দৃষ্টি অভাগী মাগিছে
1113 আপন সন্তান-লাগি; সূর্য চন্দ্র হতে
1114 পশুপক্ষী পতঙ্গ অবধি--- কোনোমতে
1115 কেহ পাছে কোনো অপরাধ লয় মনে,
1116 পাছে কেহ করে ক্ষোভ, অজানা কারণে
1117 পাছে কারো লাগে ব্যথা, সকলের কাছে
1118 আকুল বেদনা-ভরে দীন হয়ে আছে।
1121 যখন বছর-দেড় বয়স শিশুর---
1122 যকৃতের ঘটিল বিকার; জ্বরাতুর
1123 দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে। দেবালয়ে
1124 মানিল মানত মাতা, পদামৃত লয়ে
1125 করাইল পান, হরিসংকীর্তন-গানে
1126 কাঁপিল প্রাঙ্গণ। ব্যাধি শান্তি নাহি মানে।
1127 কাঁদিয়া শুধালো নারী, ``ব্রাহ্মণঠাকুর,
1128 এত দুঃখে তবু পাপ নাহি হল দূর!
1129 দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই,
1130 দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই!
1131 তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাছারে!
1132 এত ক্ষুধা দেবতার! এত ভারে ভারে
1133 নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা,
1134 সর্বস্ব খাওয়ানু তবু ক্ষুধা মিটিল না!'
1135 ব্রাহ্মণ কহিল, ``বাছা, এ যে ঘোর কলি।
1136 অনেক করেছ বটে তবু এও বলি---
1137 আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো?
1138 সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো?
1139 দানবীর কর্ণ-কাছে ধর্ম যবে এসে
1140 পুত্রেরে চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে,
1141 নিজ হস্তে সন্তানে কাটিল; তখনি সে
1142 শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমেষে।
1143 শিবিরাজা শ্যেনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে
1144 আপন বুকের মাংস কাটি দিল খেতে---
1145 পাইল অক্ষয় দেহ। নিষ্ঠা এরে বলে।
1146 তেমন কি এ কালেতে আছে ভূমণ্ডলে?
1147 মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি
1148 মার কাছে--- তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি
1149 ছিল এক বন্ধ্যা নারী, না পাইয়া পথ
1150 প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত
1151 মা-গঙ্গার কাছে। শেষে পুত্রজন্ম-পরে,
1152 অভাগী বিধবা হল; গেল সে সাগরে,
1153 কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা-গঙ্গারে ডেকে,
1154 `মা, তোমারি কোলে আমি দিলাম ছেলেকে---
1155 এ মোর প্রথম পুত্র, শেষ পুত্র এই,
1156 এ জন্মের তরে আর পুত্র-আশা নেই।'
1157 যেমনি জলেতে ফেলা, মাতা ভাগীরথী
1158 মকরবাহিনী-রূপে হয়ে মূর্তিমতী
1159 শিশু লয়ে আপনার পদ্মকরতলে
1160 মার কোলে সমর্পিল।--- নিষ্ঠা এরে বলে।''
1162 মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির ক'রে,
1163 আপনারে ধিক্কারিল--- ``এত দিন ধরে
1164 বৃথা ব্রত করিলাম, বৃথা দেবার্চনা---
1165 নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না।''
1167 ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন
1168 জ্বরাবেশে; অঙ্গ যেন অগ্নির মতন।
1169 ঔষধ গিলাতে যায় যত বার বার
1170 পড়ে যায়--- কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর।
1171 দন্তে দন্তে গেল আঁটি। বৈদ্য শির নাড়ি
1172 ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি।
1173 সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে
1174 একটি মলিন দীপ শয়নশিয়রে,
1175 একা শোকাতুরা নারী। শিশু একবার
1176 জ্যোতিহীন আঁখি মেলি যেন চারি ধার
1177 খুঁজিল কাহারে। নারী কাঁদিল কাতর---
1178 ``ও মানিক, ওরে সোনা, এই-যে মা তোর,
1179 এই-যে মায়ের কোল, ভয় কী রে বাপ।''
1180 বক্ষে তারে চাপি ধরি তার জ্বরতাপ
1181 চাহিল কাড়িয়া নিতে অঙ্গে আপনার
1182 প্রাণপণে। সহসা বাতাসে গৃহদ্বার
1183 খুলে গেল; ক্ষীণ দীপ নিবিল তখনি;
1184 সহসা বাহির হতে কলকলধ্বনি
1185 পশিল গৃহের মাঝে। চমকিল নারী,
1186 দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্য়াতল ছাড়ি;
1187 কহিল, ``মায়ের ডাক ঐ শোনা যায়---
1188 ও মোর দুখীর ধন, পেয়েছি উপায়---
1189 তোর মার কোল চেয়ে সুশীতল কোল
1193 অদূরে জাহ্নবীজলে, এসেছে জোয়ার
1194 পূর্ণিমায়। শিশুর তাপিত দেহভার
1195 বক্ষে লয়ে মাতা, গেল শূন্য ঘাট-পানে।
1196 কহিল, ``মা, মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে
1197 তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা, জুড়ায়ে।
1198 একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে
1199 একমনে।'' এত বলি সমর্পিল জলে
1200 অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে
1201 চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না।
1202 ধ্যানে নিরখিল বসি, মকরবাহনা
1203 জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে
1204 কোলে করে এসেছেন, রাখি তার শিরে
1205 একটি পদ্মের দল। হাসিমুখে ছেলে
1206 অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী-কোল ফেলে
1207 মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর।
1208 কহে দেবী, ``রে দুঃখিনী, এই তুই ধর্,
1209 তোর ধন তোরে দিনু।'' রোমাঞ্চিতকায়
1210 নয়ন মেলিয়া কহে, ``কই মা... কোথায়!''...
1211 পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী;
1212 গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি।
1213 চীত্কারি উঠিল নারী, ``দিবি নে ফিরায়ে!''
1214 মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।
1219 কথা ও কাহিনী --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
1222 কহিলা হবু, ``শুন গো গোবুরায়,
1223 কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র---
1224 মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায়
1225 ধরণী-মাঝে চরণ-ফেলা মাত্র।
1226 তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি,
1227 রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি।
1228 আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,
1229 রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি।
1230 শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার,
1231 নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।''
1233 শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন,
1234 দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে।
1235 পণ্ডিতের হইল মুখ চুন,
1236 পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে।
1237 রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,
1238 কান্নাকাটি পড়িল বাড়ি-মধ্যে,
1239 অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি
1240 কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে---
1241 ``যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে,
1242 পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে।''
1244 শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি;
1245 কহিল শেষে, ``কথাটা বটে সত্য।
1246 কিন্তু আগে বিদায় করো ধূলি,
1247 ভাবিয়ো পরে পদধূলির তত্ত্ব।
1248 ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা
1249 তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে,
1250 কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা
1251 উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে।
1252 আগের কাজ আগে তো তুমি সারো,
1253 পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো।''
1255 আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,
1256 যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী
1257 যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী---
1258 দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী।
1259 বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,
1260 ফুরায়ে গেল উনিশ-পিপে নস্য।
1261 অনেক ভেবে কহিল, ``গেলে মাটি
1262 ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?''
1263 কহিল রাজা, ``তাই যদি না হবে,
1264 পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?''
1266 সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে
1267 কিনিল ঝাঁটা সাড়ে সতেরো লক্ষ,
1268 ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে
1269 ভরিয়ে দিল রাজার মুখ বক্ষ।
1270 ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ
1271 ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য;
1272 ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,
1273 ধুলার মাঝে নগর হল উহ্য।
1274 কহিল রাজা, ``করিতে ধুলা দূর,
1275 জগত্ হল ধুলায় ভরপুর।''
1277 তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক
1278 মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি।
1279 পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
1280 নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।
1281 জলের জীব মরিল জল বিনা,
1282 ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা।
1283 পাঁকের তলে মজিল বেচা-কিনা,
1284 সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা।
1285 কহিল রাজা, ``এমনি সব গাধা
1286 ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা।''
1288 আবার সবে ডাকিল পরামর্শে;
1289 বসিল পুন যতেক গুণবন্ত---
1290 ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে
1291 ধুলার হায় নাহিকো পায় অন্ত।
1292 কহিল, ``মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,
1293 ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।''
1294 কহিল কেহ, ``রাজারে ঘরে রাখো,
1295 কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র।
1296 ধুলার মাঝে না যদি দেন পা
1297 তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না।''
1299 কহিল রাজা, ``সে কথা বড়ো খাঁটি,
1300 কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ---
1301 মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
1302 দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ।''
1303 কহিল সবে, ``চামারে তবে ডাকি
1304 চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী।
1305 ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি
1306 মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি।''
1307 কহিল সবে, ``হবে সে অবহেলে,
1308 যোগ্যমত চামার যদি মেলে।''
1310 রাজার চর ধাইল হেথা হোথা,
1311 ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম।
1312 যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা,
1313 না মিলে তত উচিতমতো চর্ম।
1314 তখন ধীরে চামার কুলপতি
1315 কহিল এসে ঈষত্ হেসে বৃদ্ধ,
1316 ``বলিতে পারি করিলে অনুমতি,
1317 সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
1318 নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
1319 ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।''
1321 কহিল রাজা, ``এত কি হবে সিধে,
1322 ভাবিয়া ম'ল সকল দেশসুদ্ধ।''
1323 মন্ত্রী কহে, ``বেটারে শূল বিঁধে
1324 কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।''
1326 ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে---
1327 মন্ত্রী কহে, ``আমারো ছিল মনে,
1328 কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে!''
1329 সেদিন হতে চলিল জুতা পরা---
1330 বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা।